সিফিলিনাম (Syphilinum)
পরিচয়।-নোসড জাতীয় ঔষধ। উপদংশ ক্ষতের বিষ হতে তৈরী হয়। অ্যান্টিসাইকোটিক ও অ্যান্টিসিফিলিটিক। উপদংশ বিষদুষ্ট জীর্ণশীর্ণ ব্যক্তির ঔষধ। সিফিলিসগ্রস্ত ব্যক্তির দূরারোগ্য রোগের পর স্বাস্থ্য ফিরে আসে না এরূপ অবস্থা।
ব্যবহারস্থল।-উপদংশ দোষদৃষ্ট দেহে যখন অন্য ঔষধ প্রয়োগে ফল হয় না। তীব্র শিরঃরোগ; পুতিনস্য; হৃদ্শূল, দন্ডশূল; উপদংশজ চোখ উঠা; মলান্ত্রের ক্ষত; অস্থিক্ষত; বাত; মানসিক বিকৃতি, মৃগী; স্বরভঙ্গ; জিহবার ক্ষত; হাঁপানি প্রভৃতি।
মন। -স্মৃতিশক্তির লোপ; বোকাটে মাথা; মেডোরিণাম রোগীর ও স্মৃতিশক্তির অভাব। রোগী বন্ধুর নাম বা শব্দের প্রথম অক্ষর ভুলে যায়। অ্যানাকর্ডিয়ামেও স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, তার নিকট সকলই স্বপ্ন বলে মনে হয়। সিফিলিনাম রোগী বা রোগিণী দিনে বেশ ভালরূপই কাটায়, কিন্তু সূর্যাস্তের পর হতে তার মানসিক ও শারীরিক সকল লক্ষণই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; সূৰ্য্যাস্ত হতে সৰ্ব্ববিধ যন্ত্রণার বৃদ্ধি। মেডোরিণাম রোগীর ঠিক এটার বিপরীত -যখন সমস্ত দিন অস্বস্তি, কিন্তু সূৰ্য্যাস্ত হলে আনন্দে রাত্রিযাপন করে। মার্ক-সল রোগীরও সব যন্ত্রণা রাত্রে বিছানার উত্তাপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সিফিলিনাম রোগী রাত্রের পর রাত্র নিদ্রাহীন অবস্থায় কাটায়, সেজন্য সে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেমনে করে। রাত্রের নামে তার ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ল্যাকেসিস, রোগীও রাত্রিকে ভয়ের চোখে দেখে, কারণ তার ক্লেশ নিদ্রা ভঙ্গের পর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সিফিলিনাম রোগী মদ পান করতে চায়, বংশগত মদ্য পানের ইতিহাস।
শিরঃরোগ।– -সিফিলিনামের শিরঃরোগ বৈকাল ৪টার পর হতে ধীরে ধীরে আরম্ভ হয়ে রাত্র ১০টা হতে ১১টা পর্যন্ত অত্যধিক হবে এবং এটার পর ধীরে ধীরে কমতে আরম্ভ করে সূর্য্যোদয়ে উপশম হবে। এটার শিরঃরোগে রোগী পাগলের মত হয়ে উঠে। আত্মহত্যা করতে চায়। ষ্ট্যানামের বেদনা আসতেও ১২ ঘন্টা লাগে এবং যেতেও ১২ ঘন্টা লাগে, তবে এটার আক্রান্ত চেপে ধরলে উপশম (কলোসিন্থ)। সিফিলিনামের বেদনা আবার পালসেটিলা, ল্যাক-ক্যান ও স্থল কেলি-বাই-এর মত স্থান পরিবর্তন করে, এমন স্থান পরিবর্তনে বেদনার হ্রাস হয়, কখন কখনও ল্যাকেসিসের রোগীর মত ঘুম ভাঙ্গিবার পর অসম্ভব বেদনার বৃদ্ধিও দেখা যায়। রোগী রাত্রকে যমের মত ভয় করে।
চোখের অসুখ। নবজাত শিশুর চোখের তরুণ প্রদাহের জন্য চোখের পাতা ফুলে উঠে, চোখদ্বয় জুড়ে যায়, চোখ হতে প্রচুর পুঁজ বের হয়, ঠান্ডা পানিতে চোখ ধুইলেই যন্ত্রণার উপশম, রাত্রে সর্ব্ববিধ যন্ত্রণার বৃদ্ধি সিফিলিনামের লক্ষণ। উপদংশদুষ্ট পিতামাতা হতেই এমন চোখের অসুখ সচরাচর দেখা যায়। অৰ্জ্জেন্টাম-নাইট্রিকামও নবজাত শিশুদের চক্ষুরোগে বিশেষ কার্যকরী ঔষধ। সেটা সাইকোটিক দোষযুক্ত জনক জননীর সন্তান ক্ষেত্রে ফলপ্রদ। ডাঃ ন্যাস বলেন, চোখ খুললেই যদি পুঁজ বের হতে থাকে, তবে মার্ক-সল উত্তম কাজ করে। সিফিলিনাম রোগীর চোখ রোগের তীব্রতা রাত্র ২টা হতে ভোর ৫টা পর্যন্ত বেশী। পালসেটিলা ও কেলি-সাল্ফ রোগীর চোখ যদি ঠান্ডা পানি দ্বারা ধৌত করা হয় তবে উপশম। নেইট্রিক-অ্যাসিড উপদংশ-বিষদুষ্ট জনক-জননীর সদ্যোজাত শিশুদের চক্ষুরোগে উপযোগী। যখন কর্ণিয়ায় ক্ষত হয়ে চোখের ভিতর পুঁজ জন্মে; চোখের পাতায় আঞ্জনি হয়ে পেকে ভিতরে পুঁজ হয়, তখন এটা উপযোগী। ডাঃ ডানহাম বলেন, হঠাৎ উপদংশ চাপা পড়ে পুঁজযুক্ত চোখ-উঠা বা আইরাইটিস রোগে যখন নেইট্রিক-অ্যাসিড প্রয়োগ করে ফল পাওয়া যায় না, তখন অ্যাসাফিটিডা ও সিফিলিনাম ব্যবহার্য্য। অ্যাসাফিটিডাও উপদংশ বা পারদঘটিত চোখ- প্রদাহে নেইট্রিক-অ্যাসিড ও সিফিলিনাম তুল্য ঔষধ। পার্থক্য এই-সিফিলিনাম রোগীর চোখের যন্ত্রণা রাত্রি ২টা হতে ৫টার ভিতর বৃদ্ধি, আর এটার রোগীর চোখের ভিতর যেন কিছু বিধিতেছে ও কর্কর্ করছে বোধ।
দন্তরোগ।-দাঁতের গোড়া ক্ষয় হই থাকে, দাঁতের ভিতর গর্ত। দাঁতের প্রান্তভাগ করাতের মত কাটা কাটা; দাঁতের আকার ক্রমশঃ (টি হওয়া, সিফিলিনামে পাওয়া যায়। ষ্ট্যাফিস্যাগ্রিয়া শিশুর দাঁতগুলিও প্রায় ঐরূপ, দাঁতের মধ্যে কাল গর্ত্ত হয়ে যায়; দুই-তিনবার মাজিলেও দাঁত পরিষ্কার হয় না। ক্রিয়োজোট শিশুর দুধের দাঁতে পোকা লেগে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙে যায়। মেজেরিয়াম-শিশুর দাঁতের মূল ক্ষয় হয়ে গেলে উপযোগী ঔষধ। দন্তমূল ক্ষয় হয়, অথচ অগ্রভাগ ঠিক থাকে- সিফিলিনামের মত-মেজেরিয়াম, থুজা; কিন্তু দন্তের অগ্রভাগ ক্ষয় হয়, মূল ঠিক থাকে-মার্কুরিয়াস ও ষ্ট্যাফিসেগ্রিয়া। সিফিলিনামের দাঁত ভঙ্গুর ও হলুদাভ রঙবিশিষ্ট।
কোষ্ঠকাঠিন্য।-দুরারোগ্য কোষ্ঠবদ্ধতা। রোগী মলদ্বারে আঙ্গুল দিয়ে মল টেনে আনে, এটা ব্যতিরেকে তার মল নিঃসৃত হয় না, কারণ সরলান্ত্র অবরুদ্ধ বোধ; প্লাম্বাম-মেট রোগীরও মলদ্বারে আঙ্গুল দিয়ে মল টেনে না আনিলে মলত্যাগ করে না, তবে প্লাম্বাম রোগী মনে করে যেন মলদ্বারের পশ্চাৎদিকে কেউ দড়ি দিয়ে বাঁধিয়া টানছে। সিফিলিনাম রোগী কোষ্ঠবদ্ধতার জন্য যদি কখনও ডুস নেয় বা পিচকারি দেয় তা হলে মল নিঃসরণ কালে কলিক যন্ত্রণা হয়। ল্যাক-ডিও সাংঘাতিক জাতীয় কোষ্ঠকাঠিন্যের একটি উত্তম ঔষধ, এতে মলত্যাগেচ্ছা মোটেই থাকে না, এটার মল শক্ত ও কঠিন। মলত্যাগের সময় ভয়ানক বেগ দিতে হয় এবং চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। অ্যানাকার্ড রোগীর সহসা মলের বেগ হয় বটে, কিন্তু বাহ্যে মোটেই হয় না, রোগী মনে করে তার মলদ্বারে ছিপি আঁটা রয়েছে; সাইলিসিয়া রোগীর সামান্য একটু বাহ্যে বের হয়ে সেটা উপরের দিকে চলে যায়। অ্যামন-মিউর রোগী তিন-চারি দিন অন্তর ভাঙ্গা ভাঙ্গা মলত্যাগ করে। নেট্রাম-মিউর রোগীর ৫/৭ দিন অন্তর একবার মলত্যাগ করে; অ্যালুমিনা রোগীর ২/৩ দিন, এমন কি কয়েক দিন পৰ্য্যন্ত মলত্যাগের ইচ্ছা থাকে না। সিফিলিনাম রোগীর মলদ্বারের ফিসার হেতু সরলান্ত্র বের হয়ে পড়ে। সরলান্ত্রে সাংঘাতিক রোগ এটা দ্বারা আরোগ্য লাভ করে-যদি উপদংশের ইতিহাস পাওয়া যায়।
প্রদর স্রাব।-প্রচুর পরিমাণে ও সেটা গড়িয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামে। অ্যালুমিনায় প্রচুর পরিমাণে প্রদরের স্রাব হয় এবং পা বেয়ে গোড়ালি পর্য্যন্ত গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু এটার শ্বেত-প্রদরও জ্বালাযুক্ত, আর সিফিলিনামের স্রাব অত্যন্ত দূর্গন্ধযুক্ত। সাধারণতঃ সিফিলিস বিষদৃষ্ট রোগীর স্রাব রাত্রে বেশী হয় ও দিনের বেলা কম থাকে।
সাংঘাতিক কৃশতা।-যদি সমস্ত শরীরে কৃশতা দেখা যায়, তা হলে এটা অ্যাব্রোটেনাম ও আয়োডিয়াম ভুল্য ঔষধ। অ্যাব্রোটেনাম শিশু অত্যন্ত জীর্ণশীর্ণ, দেখতে ঠিক একটি মর্কটের মত, তার পা দুইটি শরীরের তুলনায় বেশী শীর্ণ; আয়োড শিশুর সিফিলিনামের মত সর্ব্বাঙ্গীণ শীর্ণতা বেশী, শীর্ণতার সাথে গ্রন্থিসকল স্ফীত, সেই সাথে অত্যন্ত খাওয়ার আকাঙ্খা, সার্সাপেরিলাও শীর্ণরোগের জন্য উত্তম, শিশুটিকে দেখিলে মনে হবে যেন একটি অল্প বয়সের বৃদ্ধ। কৃশতায় ক্যাল্কে-ফসও উপযোগী।
নাকের নানাবিধ রোগ। -উপদংশজনিত পুতিনস্য হয়ে নাক হতে অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত চাড়া চাবড়া শ্লেষ্মা নিঃসৃত হয়। নাকের ভিতর অনবরত চুলকায়, রাত্রে তার সমস্ত উপসর্গের বৃদ্ধি; ওজিনা রোগে অরাম, নেইট্রিক-অ্যাসিড প্রভৃতি ঔষধ প্রয়োগ করে যখন আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না, তখন সিফিলিনাম ব্যবহাৰ্য্য।
চৰ্ম্মরোগ।-ডাঃ অ্যালেন বলেন-যখন উপদংশ বিষদুষ্ট ব্যক্তির বা যারা উপদংশজাত ক্ষত বাহ্য-মলমাদি প্রয়োগ করে নিরাময় করে, তাদের সাংঘাতিক আকারের চর্মরোগ ও কুষ্ঠ রোগে ভুগতে দেখা যায়। অপর ঔষধ না দিয়ে সেই সকল রোগীকে উচ্চ শক্তির সিফিলিনাম প্রয়োগ করলে রোগ শীঘ্রই উপশম লাভ করে থাকে। উপদংশ রোগ যখন সুনির্ব্বাচিত ঔষধে আরোগ্য লাভ করে না, তখন সিফিলিনাম ব্যবহাৰ্য্য।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ।-রাত্রি ১টা হতে ৪টার ভিতর বৃদ্ধি। শ্বাসকৃচ্ছ্রতার আধিক্য। দিনের বেলা কম। শ্বাসরোধক হুপিং-কাশি যদি রাত্রেই সাংঘাতিক হয় ও কাশির সময় প্রাণান্তক বমন দেখা যায়, তখন এটা ব্যবহাৰ্য্য।
হৃদযন্ত্রের বেদনা।-রাত্রির দিকে হৃৎপিন্ডের উপর হতে নীচের দিক পর্যন্ত কর্ত্তনবৎ বেদনা। মেরুদন্ড। -উপরাংশের বক্রতা, নিম্নাঙ্গের সাংঘাতিক যন্ত্রণা, উরুদ্বয়ের অসহ্য বেদনা। রাত্রে বৃদ্ধি, ঠান্ডা পানি ঢালিলে উপশম, উত্তাপ প্রয়োগে বৃদ্ধি।
বৃদ্ধি।-রাত্রে; গ্রীষ্মে; সমুদ্র তীরে; নড়াচড়ায়; গরমে শীতকালে।
হ্রাস। দিনে; ঘুরে বেড়ালে; ঠান্ডা পানিতে (চোখ)।
শক্তি।-২০০, ১০০০ ও তদূর্ধ্ব।