ষ্ট্যানাম (Stannum)
ব্যবহারস্থল।-ক্রিমিদোষ নাশক। ফুসফুসের নানাবিধ রোগ, যথা – ক্ষয়কাশি, হাঁপানি, রক্তোৎকাস, শ্লেষ্মাপ্রধান যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, স্নায়ুশূল, পক্ষাঘাত, বিলোপী জ্বর, মূৰ্চ্ছাবায়ু, মৃগী, প্রদরস্রাব, জরায়ু-চ্যুতি প্রভৃতি।
ক্রিয়াস্থল। -মন, স্নায়ু-বিধান, ক্রিমি ও শ্বাসযন্ত্রের উপর ক্রিয়া
মন।-রোগিণী বিমর্ষ ও দুঃখিত। সর্বদাই কান্না পায়, কিন্তু কাঁদিলে অসুখ বেশী হয়। পালসেটিলা রোগিণী সর্বদাই অশ্রুপূর্ণলোচনে থাকে, যাহাকে বলা যায় ছিঁচকাদুনে। নেট্রাম-মিউর রোগিণীও কথায় কথায় কাঁদে, সান্ত্বনা দিলে তার কান্না আরও বেশী পায়। অ্যানাকার্ডিয়াম রোগিণীরও কান্না আছে, তবে কাঁদিলে তার রোগের শান্তি হয়। ক্যামোমিলা শিশুর কথায় কথায় কান্না ও রাগ, বুঝাইলে কান্না ও রাগের নিবৃত্তি হয় না। ষ্ট্যানাম রোগিণীর পুরুষদের উপর অত্যন্ত বিদ্বেষ (প্যালস), তাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে কথা বলতে চায় না, যদিও বা বলে অনিচ্ছাপূর্বক। সামান্য পরিশ্রমে তার হৃৎস্পন্দন উপস্থিত হয়, এমন কি ঝি-চাকরকে সংসারের কাজ সম্বন্ধে উপদেশ দিতে গেলেও তার হৃৎস্পন্দন হয় (আইবেরিস)। সে সর্বদা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকে। লোকসমাজে যেতেও তার অত্যন্ত ভয়। জেলস রোগীর লোকসমাজে যেতে হলেই মলবেগ হয়।
প্রদর্শক লক্ষণ।-বুকে ও গলায় দুর্বলতা অনুভব করে; বুকের মধ্যে খালি খালি বোধ করে। যন্ত্রণা ধীরে ধীরে আসে ও ধীরে ধীরে চলে যায়। নড়াচড়ায় বৃদ্ধি। গলা শুষ্ক, গলায় হুলফোটান বেদনা। চটচটে গয়ার, উঠান যায় না। উঠাবার চেষ্টা করলে গা-বমি-বমি করে। পেটে খালি খালি বোধ। কলিক, জোরে চাপলে উপশম; কাশি, অত্যধিক শ্লেষ্মা উঠে; সেটার স্বাদ মিষ্ট বা লবণাক্ত রান্নার গন্ধে গা-বমি-বমি করে। জরায়ুর স্থানচ্যুতি, সেইসঙ্গে পেটে খালি খালি ভাব ও মাসিক ঋতু সকাল সকাল হয় ও প্রচুর পরিমাণে হয়। প্রদর-স্রাব, ‘সেই সাথে অত্যন্ত দুর্বলতা। স্রাব পীতবর্ণ, চটচটে; প্রত্যুষে বৃদ্ধি। হাসিবার সময়, গান করার সময় ও কথা বলবার সময় কাশি। ডানদিকে শুইলে বৃদ্ধি। ঘুমাবার সময় একটি পা গুটাইয়া রাখে ও অন্য পাদুটি ছড়িয়ে রাখে। হাতে জোর থাকে না, জিনিস-পত্র হাত হতে পড়ে যায়। সিঁড়ি হতে নামিবার সময় মাথা ঘোরে। প্রসববেদনাকালে রোগী হাঁপিয়ে পড়ে। যক্ষ্মা, রোগী বিমর্ষ ও হতাশ। জিব, গয়ার ও প্রস্রাব হলদে। নরম মলও কোঁথ দিয়ে বের করতে হয়। শিশুদের মৃগী, তড়কা। হাত মুঠা করে। অত্যন্ত ক্ষুধা ও পিপাসা। সন্ধ্যায় হাত ফোলে। হাত গরম।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ।-রোগীর যে কোন কাশিই হোক না কেন শ্লেষ্মা প্রচুর পরিমাণে বের হওয়া এটার বিশেষত্ব। গয়ারের স্বাদ মিষ্ট, কখনও বা লবণাক্ত। গয়ার দেখতে ডিমের সাদা অংশের মত। কাশির সময় বুকে খালি খালি বোধ।
১. ব্রঙ্কাইটিস।-বায়ুনলীর ভিতর প্রচুর পরিমাণে শ্লেষ্মা জমে থাকে এবং সামান্য একটু কাশিতেই গয়ার বের হয়ে থাকে; অ্যান্টিম-টার্ট রোগীরও বায়ুনলীর ভিতর প্রচুর শ্লেষ্মা জমে, কিন্তু সেটা সে কাশিয়া মোটেই তুলতে পারে না। ষ্ট্যানাম রোগীর শ্লেষ্মা তুলে ফেলিবার পর বুকের ভিতর ক্ষত অনুভব এবং সেখানে সূচীবিদ্ধবৎ বেদনা। রোগী এত ক্ষীণ হয়ে যায় যে, কথা বলতে পারে না। শেষরাত্রে ৪/৫ টার সময় কাশি হয়ে শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়।
হাঁপানি।– সামান্য সর্দি হতে শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়ে থাকে। সন্ধ্যাবেলা তাঁর হাঁপ ধরে, রোগী তার বস্ত্রাদি আলগা করে দিতে বাধ্য হয়। হাঁপের সময় তার বুকের ভিতর ঘড়ঘড় সোঁ সোঁ শব্দ হয়, শরীর চালনায় বৃদ্ধি। ব্রাইয়োনিয়ার কাশি ও টানও নড়াচড়ায় বেশী হয়, তবে এটার কাশির সাথে রোগীর অত্যন্ত পানিপিপাসা থাকে। ষ্ট্যানামের কাশি শুয়ে থাকলেও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
কাশি।-শুষ্ক কাশির জন্যও ষ্ট্যানাম উপযোগী। এটার কাশি গভীর, কর্কশ ও শুষ্ক। এত কাশি যে, কাশলে পর তার মাথার মধ্যে ঝনঝন করতে থাকে। সে উপর্যুপরি তিনবার কাসে, মার্কারিতে দুবার উপর্যুপরি কাশি হয়, একসঙ্গে তিন বা চারিবার কাশি বেলেডোনার পরিচায়ক। রোগী কথা বললে (হায়ো, রিউমেক্স), গান, করলে (ড্রসে, হায়ো, স্পঞ্জিয়া), হাস্য করলে (চায়না), ডানদিকে শুইলে (ফস) এবং গরম দ্রব্যাদি পান করলে (ক্যান্সি, ইগ্নে) কাশি বেশী হয়। ষ্ট্যানামের গয়ার প্রায়ই নোনতা, কিন্তু লবণাস্বাদযুক্ত গয়ারের জন্য সিপিয়া ও কেলি-আয়োড উত্তম, এদের গয়ার ঘন ও সবুজ, আর ষ্ট্যানামের গয়ার সাদা, প্রচুর ও দুর্গন্ধযুক্ত।
ক্ষয়কাশি।-প্রথমাবস্থায় যখন প্রচুর পরিমাণে গয়ার উঠে, কাশি অত্যন্ত বিরক্তিজনক। কাশির – সাথে গাঢ় সবুজ বা অত্যন্ত সাদা মিষ্টস্বাদযুক্ত গয়ার উঠে এবং গয়ার উঠবার পর ও কথা বলবার পর বক্ষঃস্থলে অত্যন্ত দুর্বলতা বোধ করে। ঐ দুর্বলতা এতই বেশী যে, রোগী মনে করে তার বুকের ভিতর কিছুই নেই, সেই সাথে অত্যন্ত রাতে ঘাম, মৃদু বা বিলোপী-জ্বর থাকলে এটাই ঔষধ। ষ্ট্যানাম-আয়োডও যক্ষ্মারোগীর উত্তম ঔষধ। এই ঔষধের রোগীর চেহারা সুন্দর, বর্ণ পরিষ্কার এবং চোখের ভ্রু দীর্ঘ। ষ্ট্যানামের রোগীর মুখমন্ডল ফ্যাকাসে, চোখ দুইটি কোটরাগত, জিহবা পীত, মুখে সুর্গন্ধ। তুলনীয়।-আর্সেনিক-আয়োড-রাত্রিকালীন ঘাম, উদরাময়, বিলোপী-জ্বর, পুঁজমিশ্রিত প্রচুর পরিমাণে গয়ার উঠে। ব্যালসামাম বিলোপী জ্বর, এবং রাত্রিকালীন ঘাম ঘড়ঘড়ে কাশি এবং প্রচুর পরিমাণে গয়ার, দুর্গন্ধ পুঁজের মত গয়ার। আয়োডাম-গলার মধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ করে শুষ্ক কাশি, রক্তমিশ্রিত গয়ার, দুর্বলতা, অত্যন্ত ক্ষুধা, রোগী সর্বদা খাই-খাই করে; উত্তাপে রোগ বৃদ্ধি। ক্যাল্কেরিয়া-হাইপোফস -অতিরিক্ত ঘাম এবং রক্তহীনতা,উদরাময় কাশি, মুখ দিয়ে রক্ত উঠা, বুকে বেদনা।
রক্তোৎকাস।-প্রচুর গয়ারযুক্ত ক্ষয়রোগীর রক্তোৎকাশিও ইহাদ্বারা আরোগ্য লাভ করে। কাশি অল্পক্ষণ স্থায়ী সেই সাথে দুর্বলতা অত্যধিক। মায়সোটিস-রোগীরও এই লক্ষণ বিদ্যমান। রোগীর রাত্রে খুম ঘাম ও কাশলে প্রচুর পুঁজবৎ শ্লেষ্মাস্রাব হয়। বাম পার্শ্বে শয়ন করলে বুকের ভিতর সূচফোটান ব্যথা।
শারীরিক দুর্বলতা ও অবসন্নতা। রোগিণী এত দুর্বল ও ক্ষীণ যে প্রতি মূহূর্ত্তে মনে করে যে, এই বুঝি মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়বে, বক্ষে দুর্বলতা ও শূন্যতা অনুভব করে। বক্ষঃস্থলের দুর্বলতার জন্য সে কথা পৰ্য্যন্ত বলতে পারে না, দুর্বলতার জন্য ধপ করে বসে পড়তে বাধ্য হয়। উপর হতে নীচে নামিতে অত্যন্ত দুর্বলতা অনুভব করে, কিন্তু নীচের তলা হতে উপরে উঠতে তার কোন কষ্ট হয় না (বোরাক্স)। ক্যাল্কেরিয়া রোগী নিম্ন হতে উচ্চে উঠতে দুর্বলতা অনুভব করে। ষ্ট্যানাম রোগীর আর একটি লক্ষণ।-রোগী যখন গান করে বা বক্তৃতাদি দেয় তখন তার ডেন্টয়েড পেশী ও বাহুর দুর্বলতা বোধ করে।
স্নায়ুশূল।-মুখমন্ডল ও উদরে স্নায়ুশূল। স্নায়ুশূলের বেদনা ধীরে ধীরে আরম্ভ হয়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বেদনাস্থল টিপিয়া ধরলে অথবা পেট জোরে চেপে ধরলে বেদনার উপশম; ‘চাপে শূলবেদনার উপশম’ কলোসিন্থেও আছে; তবে কলোসিন্থের বেদনা তরুণ, ঐ বেদনা বহুদিন স্থায়ী হলে ষ্ট্যানাম উপযোগী। অ্যাসিড-সাক্ষের বেদনা ষ্ট্যানাম রোগীর মতই ধীরে ধীরে আসে, কিন্তু হঠাৎ চলে যায়। চিনিনাম-আর্স-অত্যন্ত দুর্বলতার সঙ্গে স্নায়ুশূল, পাকস্থলীর বেদনা, আহারে উপশম, নির্দিষ্ট সময়ে রোগের উপস্থিতি। ম্যাগ-ফস-নানা প্রকৃতির স্নায়ুশূল বেদনা, উত্তাপে উপশম। স্পাইজিলিয়া-বামদিকের স্নায়বিক বেদনা, বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেদনাও বাড়ে; যত বেলা কমে, বেদনাও তত হ্রাস পায়।
পক্ষাঘাত।-অতিরিক্ত দুর্বলতার জন্যই পক্ষাঘাত হয়ে থাকে। ষ্ট্যানাম রোগীর বাম অঙ্গেই সাধারণতঃ পক্ষাঘাত বেশী হয়। তার আক্রান্ত দিকের বাহু এবং ঐ দিকের বক্ষের উপর বোধ হয় যেন একটি অত্যন্ত ভারী দ্রব্য চাপান আছে। পক্ষাঘাতিক দুর্বলতার জন্য তার হাতের দ্রব্যাদি পড়ে যায়। বাহুর ও হাতের আক্ষেপিক কম্পন। ষ্ট্যানাম রাইটার্স-ক্র্যাম্পের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
ক্রিমি।-ডাঃ টেষ্টি বলেন, ষ্ট্যানাম সেবন করার পর দীর্ঘ-ক্রিমি ও সূত্র-ক্রিমি বের হয়, কিন্তু হানেমান বলেন, ষ্ট্যানাম ৩x, চূর্ণ সেবনে ক্রিমিগুলি অচৈতন্য হয়ে পড়ে এবং ডাঃ গ্যারেন্সি বলেন যে, অল্প বয়স্ক বালকদের ক্রিমিজনিত বা অন্য কোন কারণে উদরশূল হলে এবং শূলের বেদনা আস্তে আস্তে বেশী হলে আস্তে আস্তে কমতে থাকলে, পেটের বেদনা খুব জোরে চাপ দিলে বা ধাত্রীর কাঁধে মাথা রাখলে উপশম লক্ষণে এটা উপযোগী ঔষধ
স্ত্রীরোগ।-মাসিক ঋতুস্রাব অকালে আরম্ভ হয়ে পরিমাণে প্রচুর হয়; ঋতুস্রাবের পূর্বে রোগিণী অত্যন্ত বিষাদে দিন কাটায় এবং ঋতুস্রাবের সময় গন্ডাস্থির মধ্যে বেদনা অনুভব করে। দুর্বলতার জন্য মনে করে জরায়ু প্রভৃতি বের হয়ে পড়েছে। জরায়ুচ্যুতি লক্ষণে ও প্রদররোগে অত্যধিক দুর্বলতা থাকলে ষ্ট্যানাম সিপিয়া অপেক্ষাও বেশী উপযোগী। এটার প্রসববেদনা হতে হতে প্রবল বেগে আসে; বেদনার তীব্রতায় রোগিণী অবসন্ন ও রুদ্ধশ্বাস হয়ে পড়ে।
প্রস্রাব। -অত্যধিক এবং ফিকা, কোন কোন সময় দুধের মত সাদা প্রস্রাব, ঘন ঘন মূত্রবেগ আসে, আবার কখন কখনও তার প্রস্রাবের বেগের অভাব হয়, মূত্রনলী পরিপূর্ণ কিন্তু বেগ নেই। ট্র্যামোনিয়াম রোগীর মূত্রাশয় মধ্যে মোটেই মূত্র সঞ্চিত হয় না। ওপিয়াম রোগীর মূত্রাশয় পরিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও মূত্রস্তম্ভ।
সম্বন্ধ।-ধীরে বেদনা আরম্ভ ও ধীরে হ্রাস লক্ষণে -প্ল্যাটি তুল্য; বক্ষঃদেশের দুর্বলতায় – আর্জেন্ট, নেট্রাম তুল্য; জোরে টিপলে শূল বেদনার উপশমে-কলোসিন্থ, গ্লাম্বাম তুল্য।
বৃদ্ধি।– হাসিলে; কথা বললে; গান করলে; ডানদিকে হুইলে; গরম পানীয় পানে; সিঁড়ি দিয়ে নামিলে ; মলত্যাগকালে।
হ্রাস।-জোরে টিপলে; গয়ার উঠাইলে; খোলা বাতাসে।
শক্তি।-৩, ৬, ২০০ ও ১০০০।