স্যানিকিউলা (Sanicula)

পরিচয়।-আমেরিকার উৎস বিশেষের পানি হতে প্রস্তুত হয়।

ব্যবহারস্থল। গাড়ীতে চড়লে বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, বালাস্থি-বিকৃতি, হাঁপানি, মৌমাছির হুল বেঁধা, যে সকল ফোঁড়াদি সহজে ফাটে না, মাথায় খুস্কি, অসাড়ে বিছানায় প্রস্রাব, পাঁচড়া, শ্বেত-প্রদর, দন্তশূল, জরায়ু-চ্যুতি, জরায়ুর অর্বুদ প্রভৃতি।

ক্রিয়াস্থল।-পুঁয়ে-পাওয়া শিশু ও রুগ্না স্ত্রীর ঔষধ। সাইলিসিয়ার সদৃশ কিন্তু শীতকাতর নয়।

মন।-রোগী অত্যন্ত অব্যবস্থিত চিত্র, অস্থির ও চঞ্চল। স্যানিকিউলা শিশু ভয়ানক একগুঁয়ে, স্বভাবতঃ সে অনবরত ক্রন্দন করে ও পা ছুঁড়িতে থাকে; ক্যামোমিলা এবং সিনাতে এমন ভাব আছে। স্যানিকিউলা শিশু এই বেশ খেলাধূলা করছে আবার সামান্য কারণেই অত্যন্ত ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে। শিশুকে কেউ স্পর্শ করলেই সে অত্যন্ত রেগে উঠে। অ্যান্টিম-ক্রুড রোগীও সামান্য স্পর্শে চটিয়া উঠে। রোগীর মন অত্যন্ত চঞ্চল, অনবরত বিষয় হতে বিষয়াত্তরে তার মন ঘুরে বেড়ায়। এটার শিশুর নিম্নগতিতে ভীষণ ভয়; সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামিতে গেলে বোরাক্স শিশুর মত ভয় পেয়ে মাতাকে জড়িয়ে ধরে।

প্রদর্শক লক্ষণ।-কোষ্ঠবদ্ধতা, মল অনেকটা বের হয়ে আসে, কিন্তু পুনরায় ভিতরে ঢুকে যায়। প্ৰকান্ড মল। উদরাময়, মল পরিবর্তনশীল। প্রতিবারেই রং বদলিয়ে যায়। কোনবারে ঘন, কোনবারে পানির মত। মলে দুর্গন্ধ। সমস্ত পেরিনিয়ামে যন্ত্রণা। মলদ্বারের আশ-পাশ হেজে যায়। প্রদর-স্রাবে অত্যন্ত পচাগন্ধ। তলপেটে বেদনা, সেইসঙ্গে মনে হয় সমস্ত জিনিষ যোনিপথ দিয়ে বের হয়ে যাবে। হাত দিয়ে চেপে ধরে। ইউট্রাসে টাটানি। পায়ের তলায় জ্বালা। পায়ের পাতায় ঘাম, মাথায় ঘাম, তাতে অত্যন্ত দুর্গন্ধ। দেহে জ্বালা সেজন্য শীতকালেও গায়ে কাপড় রাখতে পারে না। গায়ের চামড়া তৈলাক্ত ও কোঁচকান। চর্মরোগ, আক্রান্ত স্থান ফাটা; হাত-পায়ে ফাটা। জিবে জ্বালা, জিব ঠান্ডা করার জন্য বাহিরে রাখে। বার বার পিপাসা, প্রতিবারে অল্প অল্প পানি পান করে। গয়ার চটচটে, দড়ির মত বেড়ে যায়। নীচের দিকে যেতে ভয় পায়। গাড়ীতে চড়ার পর গা- বমি-বমি ও বমি। শিশু দুধপানের পরই বমি করে। নুন খেতে ইচ্ছা, খাওয়ার সময় মলবেগ পায়। যন্ত্রণা ডানদিকে হতে বাঁদিকে যায়। সদৃশ ঔষধ। -জরায়ু রোগের লিলিয়াম-টাই তলপেটের সমস্ত পদার্থই যোনিদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে এমন একটা অনুভূতি আছে সেজন্য রোগিণী পায়ের উপর পা দিয়ে চেপে বসে। জরায়ু নীচের দিকে নেমে আসছে এমন বোধ, এই সঙ্গে হৃদ্রোগ থাকলে অধিকতর উপযোগী হয়ে থাকে। সিপিয়ায় ঠিক ঐ প্রকারের লক্ষণ আছে, কিন্তু লিলিয়াম সাধারণতঃ নূতন অবস্থায় এবং সিপিয়া রোগ পুরাতন হলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষতঃ লিলিয়ামের মত সিপিয়ার হৃৎপিন্ডের গোলযোগ থাকে না। মিউরেক্স-জরায়ুতে চাপ বোধ এবং বেদনা, ঐ বেদনা বক্ষঃস্থল পৰ্য্যন্ত চালিত হয়। জরায়ু যোনিদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে এমন অনুভূতি (সিপিয়ার মত), কিন্তু সিপিয়ার কামেচ্ছা থাকে না, মিউরেক্সে সেটা প্রবল। পডোফাইলাম যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ু বের হয়ে পড়বে, এমন অনুভূতি সাধারণতঃ প্রসবের পরে এবং কোন ভারি দ্রব্য তুলিবার পরে এমন মনে হয়, এই সঙ্গে ডানদিকের ডিম্বকোষে বেদনা ও প্রদাহ থাকে।

জীর বাতরোগ। -কাঁধে, বিশেষত বাম কাঁধে বাত; বেদনা উত্তাপে উপশম। হাত উঠান সম্ভব নয় সমস্ত শিরদাঁড়ায় ঠায় ঠান্ডা বোধ। গাঁটে গাঁটে বেদনা; ছটফট করে। হাতের তালুতে জ্বালা। বাম উরু-সন্ধিতে বাত, নড়াচড়ায় ও ঠান্ডায় বেশী। রাত্রি ৯টা হতে মধ্যরাত্রির পর পর্য্যন্ত বৃদ্ধি। তুলনীয়।-স্যাঙ্গুইনেরিয়া-ডান কাঁধে এবং ডান হাতের বেদনা। সেটা অবশ হয়ে যায়। (কিন্তু স্যানিকিউলার বামদিকে উরুদেশে বেদনা)। বামস্কন্ধে বাতের বেদনায় ফেরাম-মেটালিকাম ও নাক্স-মস্কেটাও ব্যবহৃত হয়ে থাকে (কিন্তু ফেরাম-মিউরিয়েটিকাম, স্যাঙ্গুনেরিয়ার মত ডানদিকের স্কন্ধ বেদনায় ব্যবহৃত হয়)।

শিশুরোগ। স্যানিকিউলা শিশুরোগের উত্তম ঔষধ। নেট্রাম-মিউর ও লাইকোপোডিয়াম শিশুর মত তারও সর্বাঙ্গীণ শীর্ণতা। সার্সাপেরিল্লার “শিশুর মত তার ঘাড়ের চামড়া কুঁচকাইয়া যায়। বৃদ্ধদের মত গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। অ্যাব্রোটেনাম-শিশুর সমস্ত দেহই শুকিয়ে যায়, কিন্তু পায়ের দিকে বেশী শুকায়। নেট্রাম-মিউর-প্রচুর পরিমাণে আহার সত্ত্বেও শিশুর শীর্ণতা এবং তার ঘাড়ের পিছন দিকটাই বেশী শীর্ণ। আয়োডিয়াম সমস্ত শরীরু সাধারণভাবে শুকায়, ক্ষুধা লেগেই আছে, সর্বদাই ক্ষুধা, খেয়ে উঠেই আবার খেতে চায়। (চুম্বক ঃ – সারা দেহের শীর্ণতায়-অ্যাব্রোটেনাম, আয়োডিন, সিফিলিনাম। নিম্নাঙ্গের শীর্ণতায় -অ্যাক্সাট্রেনাম, আয়োডিন, স্যানিকুলা, টিউবারকুলিন। উর্ধ্বাঙ্গের শীর্ণতায় লাইকোপোড, নেট্রাম-মিউর, সোরিণাম। গলার দিকে-নেট্রাম-মিউর, স্যানিকুলা)। সাইলিসিয়া শিশুর মত, তার ঘাম ও মল খানিকটা বের হয়ে আবার ঢুকে যায়, কিন্তু স্যানিকিউলা শিশু আদৌ শীতকাতর নয়। শীতের সময়েও সে গায়ে কাপড় রাখতে পারে না। শিশু দুধ ভালবাসে সত্য, কিন্তু দুধ পান করার অনতি পরেই চাপ চাপ দধির মত বমি করে। শিশুর ক্ষুধা অত্যধিক। শিশুর পানিপিপাসাও বেশী, সে মহা আগ্রহের সাথে পানি পান করে।

পাকস্থলীর বিশৃঙ্খলা। স্যানিকিউলা রোগী যানে ভ্রমণ করলে তার বিবমিষার উদ্রেক হয় (ককিউলাস, কলচি, নাক্স-মস্ক, ট্যাবে)। পিপাসা খুব; স্যানিকিউলা রোগী আর্স রোগীর মত বারংবার অল্প অল্প পানি পান করে, ঐ পানি বমি করে উঠাইয়া দেয়। রোগীর ক্ষুধা বেশ। নেট্রাম-মিউর রোগীর মত আহারের পূর্বে সে ক্ষুধায় উন্মত্তবৎ হয়ে উঠে, কিন্তু ২/১ গ্রাস খেলেই তার পাকস্থলী ফুলে উঠে। রোগী টাটকা রুটি ভিন্ন খেতে পারে না। নেট্রাম-মিউর রোগী রুটি মোটেই পছন্দ করে না।

কোষ্ঠকাঠিন্য।-স্যানিকিউলা কোষ্ঠকাঠিন্যের একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। পেটের ভিতর দুই-তিন দিনের মল সঞ্চিত না হলে আদৌ মলত্যাগের বেগ হয় না (অ্যালিউ, ওপিয়াম); অনেক বেগ দিবার পর মলের কিছু অংশ বের হয় এবং অপর অংশ সাইলিসিয়ার মত উপরের দিকে চলে যায় (থুজা)। নরম মলও অনেক বেগ দিবার পর বের হয়।

উদরাময়। উদরাময়ের মল নানাবর্ণের, নানাপ্রকৃতির। কখনও ব্যাঙ্গাচিপূর্ণ পানির মত মল, কখনও বা ভাঙ্গা ডিম্বের মত মল। আর্জেন্টামের মল কিছুক্ষণ সংরক্ষিত থাকলে সবুজ বর্ণের হয়, স্যানিকিউলার মলও সেইরূপ সবুজ হয়ে থাকে। ম্যাগ্নেসিয়া-কার্বে আমরা যেরূপ পচা পুষ্করিণীর শেওলাগোলা পানির মত মল পাই স্যানিকিউলাতেও সেরূপ মল আছে। স্যানিকিউলার মল পালসেটিলার মলের মত পরিবর্তনশীল। রোগী আহারের পরই ছুটে পায়খানায় যায়। ক্রোটন-টিগ শিশুও আহারের পর ঐরূপ ছুটে পায়খানায় যায়। স্যানিকিউলার বাহ্যে হতে অত্যন্ত দুর্গন্ধ বের হয়। শরীর হতে মলত্যাগের গন্ধ কিছুতেই যায় না (সাম্ফ, সোরিণাম)।

প্রস্রাব।-রোগীর মূত্রাশয়ের উপর কোন আয়ত্ত থাকে না, অসাড়ে প্রস্রাব হয় (কষ্টি, কেলি- ফস)। হঠাৎ তার প্রস্রাবের বেগ উপস্থিত হয়েছে-অনেক চেষ্টা করেও প্রস্রাবের বেগ ধারণ করতে পারে না। শিশু যখন বাহ্যে করতে বসে, তখন সে প্রস্রাব করার জন্য খুব জোরে জোরে বেগ দেয় এবং প্রস্রাব করার পূর্বে সে চীৎকার করে কাঁদতে থাকে (লাইকো)। শিশুর প্রস্রাব যদি বিছানায় লাগে তা হলে বিছানায় লালবর্ণের দাগ পড়ে (লাইকো, প্যারেইরা)। শিশুর জননেন্দ্রিয়ের ভিতর হতে আমিষ গন্ধ বের হয়।

স্ত্রীরোগ।-এটার প্রদর-স্রাব হতে মাছ-ধোয়ানি পানির মত উগ্র গন্ধ বের হয়; যদি কান – পাকা রোগে এমন গন্ধ বের হয়, তবে টেলিউরিয়াম এবং গুহ্যদ্বার হতে এমন রস নির্গমনে, ক্যাল্কেরিয়া ব্যবহার্য্য। স্যানিকিউলা রোগী মনে করে তার যোনিদ্বার দিয়ে যন্ত্রাদি বের হয়ে আসছে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে রোগিণী উপশম বোধ করে এবং সামান্য সঞ্চালনেও উপসর্গ বাড়ে। সিপিয়া রোগিণীর মত জননাঙ্গ হাত দিয়ে চেপেও রাখে। লিলিয়াম-টাইগ্রিনামের লক্ষণও এই প্রকার। রোগিণী মনে করে, হাত দিয়ে চেপে না রাখলে অথবা ভাল ভাবে চেপে না বসলে তার তলপেটের নাড়ী-ভুঁড়ি সব বের হয়ে যাবে। লিলিয়ামে প্রায়ই হৃৎপিন্ডের গোলযোগ থাকে এবং লিলিয়াম তরুণ অবস্থাতেই ব্যবহার বেশী ব্যবহৃত হয়। সিপিয়া জরায়ুভ্রংশের অন্যতম উৎকৃষ্ট ঔষধ এবং পুরাতন অবস্থাতেই ব্যবহার বেশী। স্ত্রীরোগ স্যানিকিউলা প্রয়োগ থাকলেও শিশুদের ক্ষেত্রেই এটা বেশী ব্যবহৃত হয়। গর্ভবতী রমণীদের নিম্নাঙ্গের স্ফীতিতেও এটা উপযোগী। এটার ঋতুস্রাব অতি বিলম্বে প্রকাশিত হয় এবং সেই সময় জরায়ুতে ভ্যাদাল ব্যথার মত ব্যথা হতে থাকে। সঙ্গমাদির পর যোনিদেশ হতে মাছ-ধোয়ানি পানির মত গন্ধবিশিষ্ট রস নিঃসৃত হয়, ভালরূপ গোসল করলেও ঐ গন্ধ যায় না।

চর্মরোগ।-শিশুর চোখের ভ্রুতে ও দাড়িতে প্রচুর আঁইসের মত খুস্কি পড়ে, কানের পশ্চাতে সাদা আঠা আঠা রসস্রাবী ক্ষত হয়, জননেন্দ্রিয় এবং গুহ্যদেশে হেজে গিয়া রস বের হয়, পায়ের আঙ্গুলে অতিরিক্ত ঘাম হয়ে ঐ স্থানে ক্ষত হয়। গ্রাফাইটিসের একজিমা এবং অন্যান্য চর্মরোগ যেমন কানের পশ্চাতে আছে, তেমনি অন্যান্য স্থানেও দেখা যায় এবং এটা হতে মধুর মত গাঢ় চটচটে রস নিঃসৃত হয়। পায়ের আঙ্গুলে অতিরিক্ত ঘাম হয়ে ক্ষত হলে যেমন স্যানিকিউলা ব্যবহৃত হয়, সেইরূপ সাইলিসিয়া। এটার ক্ষত হতে অত্যন্ত দুর্গন্ধ রক্তমিশ্রিত, কলতানির মত রস বের হয়। উপরন্তু ঐ ঘাম বসে গিয়াও নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

সদৃশ।-ক্যামো, আয়োড, নেট্রাম মিউর, সার্সা, ক্যাল্কে, টিউবারকিউ, ট্যারাক্স, সাইলি, ইথুজা, সিপিয়া, মিউরেক্স, লিলিয়াম, লাইকো, অ্যালিউমিনা তুল্য ঔষধ।

বৃদ্ধি। -স্পর্শে, সামান্য চাপে; গাড়ীতে চড়িয়া যাবার সময়, হাত উঠাইলে; উচু-নীচুতে পা পড়লে; জাগিবার পর (নাক- চোখ রগড়ায়); রাত্রি ৯টা হতে ১২টা পৰ্য্যন্ত (অস্থিরতা)।

হ্রাস।-বিশ্রামে; খোলা বাতাসে; ধূমপানে (গা-বমি-বমি)। তরুণ অবস্থায় যে সকল লক্ষণ থাকলে ক্যামোমিলা প্রয়োগ করা হয় প্রাচীন রোগে সেই সকল লক্ষণে স্যানিকিউলা কাজে আসে।

শক্তি।–৬x, ১২, ৩০, ২০০।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!