স্যাঙ্গুইনেরিয়া-ক্যানাডেন্সিস (Sanguinaria Canadensis)
পরিচয়।-অপর নাম টার্মেরিক, আমাদের দেশীয় নাম হরিদ্রা।
ব্যবহারস্থল।-শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ ও শিরঃরোগ, ফুসফুস-প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, স্বরভঙ্গ, গলনলী-প্রদাহ, বধিরতা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বাত, রক্তামাশয়, অর্শ, কামলা, স্নায়ুশূল, রজোনিবৃত্তিকালীন রোগ প্রভৃতি।
ক্রিয়াস্থল।–রক্তসঞ্চালন ও শ্লৈষ্মিক-ঝিল্লীর উপর প্রধান ক্রিয়া। পাকাশয়িক স্নায়ুর উপরেও ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
স্বভাব ও গঠন।-রোগীর চিত্ত-চাঞ্চল্য অত্যধিক। কোপনভাব ও অনুভবাধিক্য। তার ঘরের মধ্য দিয়ে কেউ চলে গেলে রোগী অত্যন্ত বিরক্ত হয়। রোগীর কি ভাল লাগে তা সে বলতে পারে না তবে ঝাল, ঝাঁজাল দ্রব্য এবং চাটনি প্রভৃতি তার খেতে ভাল লাগে। রোগীর মুখমন্ডলের শিরাসকল লাল হয়ে ফুলে উঠে। ঋতুস্রাবের সময় যুবতীদের মুখমন্ডলে ব্রণাদি উদ্ভেদ বের হয়ে থাকে।
প্রদর্শক লক্ষণ।– হাতের তলায় ও পায়ের তলায় জ্বালা, নানাস্থানে জ্বালা। সর্দি হঠাৎ বন্ধ হয়ে উদরাময়। রোগ দেহের ডানদিকে আক্রমণ করে। মাধাধরা ডানদিকে। শিরঃরোগ অন্ধকারে চুপ করে পড়ে থাকে। নাকে, কানে ও ইউট্রাসে পলিপাস। রক্ত পড়ে। জিব সাদা। অত্যন্ত পিপাসা। গা-বমি-বমি ও সেই সঙ্গে লালাস্রাব। রেক্টামের ক্যান্সার। রোগী দেহে রক্তোচ্ছ্বাস বোধ করে (সালফার)। প্রদর-স্রাব, তাতে দুর্গন্ধ, যেখানে লাগে সে স্থান হেজে যায়। ঋতুলোপকালীন কষ্ট। ঐ সময় রজঃস্রাব। গন্ডদ্বয়ের সীমাবদ্ধ আরক্ততা। কাশি, ঢেঁকুর উঠলে উপশম। কাশি, বুকের ডানদিকে জ্বালা। গয়ার চটচটে, লোহার মরিচার মত রঙ। বুক সুড়সুড় করে ও তজ্জন্য কাশি, রাত্রে বেশী। স্রাব মাত্রেই ঝাঁজাল। হাঁপানি ও সেইসঙ্গে পেটের গোলমাল। গয়ার পুঁজের মত, পচা গন্ধ। মাসিক ঋতু বন্ধ থাকে ও মুখ দিয়ে রক্ত উঠে। ডান কাঁধের বাত। বাম উরু-সন্ধির বাত। গরম সহ্য হয় না।
শিরঃরোগ।-ডান দিকের শিরঃরোগ। স-বমন শিরঃরোগ। মাথার যন্ত্রণা-স্পাইজিলিয়ার মত সূর্যোদয়ের পর হতে আরম্ভ হয়ে বৈকালে কমতে থাকে। আধকপালে মাথাব্যথা অথবা সামনের দিকে মাথার যন্ত্রণা। রোগীর মাথাব্যথা এত সাংঘাতিক হয় যে, সে আলো বা শব্দ সহ্য করতে পারে না, যা খায় বমন করে দেয়, দুই পাশের শিরাসকল দপদপ করতে থাকে। বেলেডোনায়ও এমন দপদপ করে, তবে স্যাঙ্গুইনেরিয়ার রোগী অপেক্ষা বেলের রোগীর মাথা গরম, মুখ আরক্তিম হয়। স্যাঙ্গুইনেরিয়া রোগী অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে থাকলে আরাম পায়। স্যাঙ্গুইনেরিয়ার আধ-কপালে · মাথার যন্ত্রণা স্পাইজিলিয়ার মত। পার্থক্য, স্পাইজিলিয়া বামদিকের আর স্যাঙ্গুইনেরিয়া ডানদিকের ঔষধ। স্যাঙ্গুইনেরিয়ার মাথার যন্ত্রণা প্রতি সাত দিন অন্তর ঘুরে আসে (স্যাবাডি, সিলিকা, সালফার); আইরিস-ভার্সি, রোগীর শিরঃরোগ প্রতি আট দিন অন্তর ঘুরে আসে।
নাকের রোগ।-ঘ্রাণশক্তি একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়, নাকের ভিতর পলিপাস বা নাসাবুদ (থুজা, ক্যাল্কে-কার্ব, ক্যাল্কে-ফস, সোরিণাম, টিউক্রি, টিউবারকিউলিনাম)। রোগী পূনঃ পুনঃ হাঁচে, পানির নাক-স্রাব এবং নাসামূলে পেষণবৎ যন্ত্রণা। নব প্রস্ফুটিত গোলাপ ফুল বা নূতন শস্যাদির রেণুর আঘ্রাণ লবার পর সর্দি বা শ্বাসস্বল্পতা। মূৰ্চ্ছাবায়ুগ্রস্তা রমণীগণ বা স্নায়বিক ধাতুর রমণীগণ ফুলের গন্ধ শুকিয়া পীড়িত বা অবসন্ন হয়ে পড়লে। পলিপাস জন্য যদি নাক হতে রক্ত পড়ে তা হলেও ব্যবহার্য্য।
মুখাভ্যস্তর।-রোগীর আস্বাদ শক্তিও লোপ পায়। রোগী মনে করে তার জিহবা অত্যন্ত ব্যথাযুক্ত। মিষ্ট দ্রব্যাদি তার নিকট তিক্ত স্বাদ লাগে; ঝাঁজাল, ঝাল ও চাটনী পছন্দ করে।
কাশি।-ইনফ্লুয়েঞ্জার সাথে কাশি থাকলে এবং হঠাৎ যদি কাশিও গয়ার বন্ধ হয়ে উদরাময় হয় তা হলে এই ঔষধ উত্তম। স্যাঙ্গুইনেরিয়া ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া প্রভৃতি রোগেও ব্যবহাৰ্য্য। ডানদিকের ফুসফুসই বেশী আক্রান্ত হয়। রাত্রে অত্যন্ত শুষ্ক কাশি হয়, সেজন্য রোগী বার বার উঠে বসতে বাধ্য হয়। কাশির প্রকোপ ঢেঁকুর উঠলে বা বায়ু নিঃসরণ হলে উপশম 1
নিউমোনিয়া।–হিপাটিজেশনের পরবর্ত্তী অবস্থা। অত্যন্ত শ্বাসস্বল্পতা, কাঠ-চেরার মত নিঃশ্বাসের শব্দ, স্বরভঙ্গ, শুষ্ক কাশি, ডানদিকের স্কন্ধপ্রসারী বেদনা। রোগী তার ডানহাত ঠিকভাবে তুলতে পারে না। লাইকোপোডের মত ডানদিকের নিউমোনিয়া রোগে উপযোগী। রোগীর বুক ও ফুসফুস মধ্যে জ্বালা করে, গয়ার অত্যন্ত ঘন, দড়ির মত, লোহার মরিচা ধরার মত বর্ণ। নাড়ী দ্রুত ও সূক্ষ্ম, মুখমন্ডল ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি শীতল, কখনও কখনও হাত-পা গরম ও জ্বালাযুক্ত। রোগীর মুখে গন্ধ ও গয়ার অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত, রোগী নিজেও গয়ারের গন্ধে বিরক্তি অনুভব করে। আর একটি বিশেষ লক্ষণ কাশির পূর্বে ও পরে বায়ুনিঃসরণ, কাশির পর শরীর উত্তপ্ত হয় এবং সে হাই তুলতে থাকে। নিউমোনিয়ার কুফল – নিউমোনিয়া সেরে গেলেও জ্বরটি সারে না। রোগী ক্রমশঃ যক্ষ্মার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাদা সাদা দুর্গন্ধ গয়ার উঠে।
হুপিং-কাশি।-অত্যন্ত সাঁই সাঁই শব্দকারী, গয়ার অতি কষ্টে নিঃসৃত হয় এবং গয়ার ঘন আঠার মত ও দড়ির মত। যতবার রাত্রে শিশু শুইতে যায় ততবারই তার কাশির বেগ হয়। তুলনীয়। কেলি-বাই-গয়ার ঘন আঠার মত। মুখ হতে দড়ির মত লম্বা হয়ে ঝুলতে থাকে। ড্রসেরা শিশু বালিশে মাথা দিলেই তার কাশির আবেগ (paroxysm) উপস্থিত হয়।
উদরাময়। -তরুণ সর্দির পর উদরাময় বা ইনফ্লুয়েঞ্জার পর উদরাময়। মল তরল ও শব্দযুক্ত, উজ্জ্বল হলুদবর্ণের, অজীর্ণ, সেইসঙ্গে বুকের ভিতর বেদনা ও কাশি। উদরাময়ের সাথে নিম্নপেটে বায়ু সঞ্চিত হয়, মলত্যাগকালে বায়ু নিঃসৃত হতে থাকে, প্রচুর বায়ু নিঃসরণে কাশির উপশম বোধ।
স্ত্রীরোগ।-বয়োসন্ধিকালের নানাবিধ রোগ। রোগিণী হতে হতে দেহে উত্তাপ বোধ করে। হাতের তলা ও পায়ের তলায় জ্বালা। রোগিণী তার গায়ের ঢাকা দূরে নিক্ষেপ করে। তার স্তনদ্বয় অত্যন্ত ব্যথান্বিত হয়। ডাঃ অ্যালেন বলেন-এমন অবস্থায় যখন ল্যাকেসিস ও সাম্ফার প্রয়োগ করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না, তখন এই ঔষধ দ্বারা চমৎকার ফল পাওয়া যায়। রজঃনিবৃত্তিকালে রক্তস্রাবে এটা একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। উজ্জ্বল সংযত রক্তস্রাবও হয়। হাতে-পায়ে জ্বালা। গন্ডদ্বয়ে সীমাবদ্ধ আড়ষ্টতা। যে সকল রমণীর অল্প ঋতুস্রাব হয় তাদের বয়ন্ত্রণ। শ্বেত- প্রদরের স্রাব অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত এবং যেখানে লাগে সেই স্থান হেজে যায়। ঋতুস্রাব অকালে প্রকাশিত হয়,ঋতুস্রাবের রক্ত কাল, দুর্গন্ধযুক্ত, মাংসখন্ডের মত চাপ চাপ রক্ত। ঋতুস্রাবকালে অত্যধিক মাথার যন্ত্রণা, বুকে টাটানি ব্যথা, বুক ধড়ফড়ানি, স্তন দুইটিতে বেদনা। যোনিদ্বারে ফুস্কুড়ির মত উদ্ভেদ বা পিপাসা
হৃত্যন্ত্রের রোগ।-মাথার তীব্র যাতনার সাথে হৃৎপিন্ডের ভয়ানক বেদনা। সন্ধিবাত, বাহ্য ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা বেদনা নিরাময় করার পর হৃৎপিন্ডের রোগ। শুষ্ক গায়ের চামড়া, অত্যধিক গাত্রদাহ, রক্তের চাপ বৃদ্ধির জন্য বুক ধড়ফড়ানি পরিচায়ক লক্ষণ।
বাতের বেদনা।-রোগীর ঘাড়ে, কাঁধে এবং বাহুতে বাতের বেদনা। অত্যন্ত ভারী দ্রব্য উত্তোলন করার ফলে কটিবাত অথবা পৃষ্ঠের বৃহৎ মাংসপেশীর বাত। বামদিকের উরুদেশে বাতের বেদনা। কোন কোন সময় এটার বেদনা স্থান পরিবর্তন করে। বাতের বেদনার জন্য তার ডানদিকের স্কন্ধ ও ডান বাহু অবশ হয়ে যায়; বাম স্কন্ধ (ফেরাম-মেট, নাক্স-মস্কেটা)। স্যাঙ্গুইনেরিয়া অহিফেনের মাদকতা দূর করে।
সম্বন্ধ।-শিরঃরোগে-বেল, আইরিস, তুল্য; বয়োসন্ধিকালের রোগে-ল্যাকে, সালফার তুল্য; ব্রঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়া রোগে–চেলি, ফস, সালফার, ভেরেট্রাম তুল্য; ডান বাহুর বাতের বেদনায়-ম্যাগ-কার্ব তুল্য; মাথাধরায় – স্পাইজেলিয়া ও নেট্রাম-মিউর তুল্য।
বৃদ্ধি।-স্পর্শে; নড়াচড়ায়; ভারী দ্রব্য উঠাইলে; কাশির সময়; হেট হলে; পরিশ্রমে; উপবাসে (মাথাধরা); সূর্য্যোদয় হতে সূৰ্য্যাস্ত পৰ্য্যন্ত (মাথাধরা)।
হ্রাস।-জোরে চাপ দিলে; শুইলে (বাত ও মাথাধরা); বাঁদিকে শুইলে; উঠে বসলে ও বায়ু নিঃসরণে (কাশি); ঢেঁকুর উঠলে; বমি হলে; নিদ্রার পর; ঠান্ডা খোলা বাতাসে; টক দ্রব্যে; অন্ধকারে।
শক্তি।– মূল-অরিষ্ট ও ৩, ৬, ৩০ শক্তি ব্যবহার্য্য।