প্ল্যাম্বামমেটালিকাম (Plumbum Metallicum)

পরিচয়।-সীসক ধাতু।

ব্যবহারস্থল।-মেরুদন্ডের প্রদাহ ও শূল, কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্ত্রবৃদ্ধি, অস্ত্রাবরোধ (ntestinal obstruction), (ntussusception), অর্শ, নাভিকুন্ডের ফোটক, রক্তাল্পতা, ধমনী অর্বুদ, মূত্রস্বল্পতা, মূত্রগ্রন্থির রোগ, বহুমূত্র, উপাঙ্গের প্রদাহ, নানাবিধ চোখের অসুখ, হাঁপানি, ক্ষুদ্রসন্ধিবাত, চর্মরোগ, যকৃতের রোগ, জিহবার পক্ষাঘাত, চোয়ালের অর্বুদ, চোয়াল আটকান, মস্তিষ্কের কোমলতা, অনুনলীর সঙ্কোচন প্রভৃতি।

ক্রিয়াস্থল। -প্রধান ক্রিয়া পেশীসমূহের উপর। রোগী বিষণ্ন ও চিন্তাপূর্ণ। মুখ হলুদাভ ও ফ্যাকাসে। অনুভূতি শক্তি ক্রমেই কমে যায়। চিমটি কাটিলে দুই-তিন সেকেন্ড পরে বুঝতে পারে।

মন।-শূলবেদনা সহ রোগীর অত্যধিক মানসিক অবসাদ, রোগ সম্বন্ধে চিন্তা ও অস্থির হয়ে পড়া। প্রবল বিকারগ্রস্ত ভাব, বিকৃত মুখভঙ্গি। রোগীর স্মৃতিশক্তির হ্রাস, স্থূলবুদ্ধি, অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত কোন কথা বুঝাইয়া না বললে নিজে অভিমত ব্যক্ত করতে সমর্থ হয় না। সহজে কোন বিষয় সে বুঝতে পারে না। গুপ্তশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়, সে যাহাকে দেখে তাকে গুপ্তশত্রু মনে করে।

প্রদর্শক লক্ষণ।-আক্রান্ত স্থান অত্যন্ত স্পর্শকাতর, হাত দেওয়া যায় না। শরীরে অনুভব শক্তির অভাব। কোন স্থানে হাত দিলে বুঝতে পারে না। অত্যন্ত শীর্ণতা। যে স্থানে পক্ষাঘাত হয় তা শীর্ণ হয়ে যায়। শূল বেদনায় রোগী অত্যন্ত প্রলাপী হয়ে উঠে। বাঁদিকে শুইলে বুক ধড়ফড় করে। বর্ষাকালে মুখ হতে লালাস্রাব। স্ত্রীলোকদের প্রায়ই গর্ভপাত হয় হাইতোলা ও গা – ভাঙ্গে। শরীরের নিম্নাঙ্গের পক্ষাঘাত। প্রস্রাবে এলবুমেন। কোষ্ঠবদ্ধতা, মল শক্ত, ডেলা-ডেলা ও কাল। পেটে বায়ু অবরুদ্ধ, সেজন্য ভয়ানক কলিক ব্যথা। পেশীগুলি আকুঞ্চিত হয়ে পেট নৌকার খোলের মত ভেতরে ঢুকে যায়। মনে হয় পেটটি শিরদাঁড়ায় টেনে বাঁধা আছে। জিব বের করতে পারে না, জিবের পক্ষাঘাত, জিব কাঁপে। মাঢ়ীর উপর দিয়ে একটি সুস্পষ্ট নীল রেখা। মাথায় চুল খুব শুষ্ক। কানে নানারূপ শব্দ। মানসিক বিষাদ ঋতুস্রাব ও শূলব্যথা পর্য্যায়ক্রমে আসে। হাতে কোন দ্রব্য উঠান যায় না। হাত ও পা ঠান্ডা। স্মরণ শক্তি কম। গায়ে ঠান্ডা হাওয়া ভাল লাগে না। মুখে মিষ্ট স্বাদ অনুভব করে। রাত্রে পায়ের ডিমে খাল ধরে। গর্ভাবস্থায় প্রস্রাব করতে পারে না।

জানি টিফ্লাইটিস।-ইলিওসিক্যাল স্থান বড়, শক্ত ও স্ফীত, ছোঁয়া যায় না। নড়াচড়ায় কষ্ট। সমস্ত পেটে টাটানি, হাত দিতে দেয় না, নাভি ভিতরে ঢুকে যায়। টক-ঢেঁকুর। গা-বমি-বমি, ওয়াক তোলা, কোষ্ঠবদ্ধতা। মুখমন্ডল উদ্বেগপূর্ণ। জিহবা শুষ্ক, ধারে ধারে লাল। জিবের মাঝখানে পিঙ্গলবর্ণের ময়লা। খুব পিপাসা। পায়ের শক্তি হ্রাস (lame feelingin legs)।

দন্তশূল।-দাঁতে গৰ্ত্ত হয়ে যায়, ফোঁপরা দাঁত। দাঁত পচা, সহজে গুড়া হয়ে যায়। দাঁতে দূর্গন্ধ, দাঁত কাল, দাঁতের উপর হলদে মিউকাস। মাঢ়ী ফোলা, মাঢ়ীতে যন্ত্রণা ও মাঢ়ীর উপর শক্ত ঢিবলী। মাঢ়ীর উপর একটি সুস্পষ্ট নীল দাগ।

তুলনীয়।– ষ্ট্যাফিসেগ্রিয়া দাঁতে পোকা লাগে, কালো হয়, ক্ষয় হয়, মাঢ়ী ফোলে, দাঁতে কিছু ঠেকিলেই রক্ত পড়ে। উপদংশ এবং প্রমেহগ্রস্ত রোগী এবং তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। প্ল্যান্টেগো – দাঁতের প্রায় যাবতীয় বেদনায়ই এটা বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এই সঙ্গে কানে বেদনা থাকলে অধিকতর উপযোগী হয়। নিন্মশক্তি আভ্যন্তরিক এবং মূল-অরিষ্ট বাহ্য প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হেক্লা-লাভা-দাঁতের মাঢ়ীতে ক্ষত, ফোড়া, নালী ঘা বা পায়োরিয়া। পোকা লেগে দাঁত ক্ষয় হয় বা দাঁতের গোড়ার অস্থিতে ক্ষত। দাঁতে শুলানি বেদনা। চেনোপডিয়াম-গ্লুকাই- দন্তশূল কানে, রগে, গন্ডাস্থি প্রভৃতি স্থানে চালিত হয়। এটার লক্ষণসকল প্ল্যান্টেগোর মত।

ঘাম।– পায়ে দুর্গন্ধ ঘাম। ঘাম ঠান্ডা ও চটচটে। ঘাম হয়, আবার শুকায়, আবার হয়, বিশেষতঃ বিছানার মধ্যে থাকার সময়।

গলার ক্ষত।— গলায় যেন একটি পুটলী মত কি আটকিয়ে থাকে। খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে গলায় ও পেটে জ্বালা। মাঝে মঝে গলনলী সরু বোধ। তরল পদার্থ গিলতে পারে, কিন্তু কঠিন পদার্থ গিলতে পারে না, মুখে উঠে আসে। কিছু গিলবার সময় গলার সঙ্কোচন। গিলবার প্রবল ইচ্ছা। গলায় চটচটে মিউকাস। গলার যন্ত্রণা বাঁ দিক হতে ডানদিকে যায়।

বাত।-মাথা নাড়বার সময় ঘাড়ে টান টান ভাব। ঘাড়ে, বুকে, পিঠে ও কোমরে বেদনা। হাত-পা ফোলা। হাত-পা আড়ষ্ট ও হাত-পায়ে যন্ত্রণা। বাহু ও পায়ে অসাড় ভাব। হাত ও পায়ে ভয়ানক যন্ত্রণা, নড়া-চড়ায় ও চাপে বৃদ্ধি। সন্ধ্যায় ও রাত্রে বৃদ্ধি। ঘাম আদৌ হয় না।

শিরঃরোগ ও চোখের অসুখ। -জড়বুদ্ধি। মাথার বেদনায় মনে হয় যেন গলা হতে মাথা পৰ্য্যন্ত একটা গোলাকার পদার্থ উঠছে। মাথায় রক্তসঞ্চয়াধিক্য জন্য মাথা অত্যন্ত গরম বোধ ও মাথার ভিতর দপদপ করতে থাকে। মাথার চুল অত্যন্ত শুষ্ক; মাথার চুল, ভ্রূলোম ও দাড়ী উঠে যায়। চোখের মধ্যে চাপ বোধ, মনে করে যেন চোখতারকা বড় হয়েছে। চোখের উপর পাতায় পক্ষাঘাত। চোখের গুরুমন্ডল হলদে।

উদরশূল।-নাভিপ্রদেশে অত্যধিক শূলবেদনা, ঐ বেদনা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে; উদর পেশী ভিতর দিকে আকৃষ্ট হয়, উদর প্রাচীর মেরুদন্ডের দিকে বসে যায়, কেউ যেন তার দিয়ে মেরুদন্ডের দিকে টানছে বোধ। পেটটি ভিতরে ঢুকে নৌকার খোলের মত দেখায়। মাঢ়ীর উপর দিয়ে সুস্পষ্ট নীল দাগ। মর্দন বা প্রবল চাপে কতকটা উপশম। ঐ বেদনার সাথে অত্যধিক কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, কোন কোন রোগী ভুক্তদ্রব্য বা মল বমন করে। প্লাম্বামের বেদনা সর্বত্রই স্নায়বিক। এই বেদনা যখন রোগীর মস্তক আক্রমণ করে তখন রোগী অত্যন্ত প্রলাপ বকে, পাগলের মত ব্যবহার করে। যখন বক্ষঃপ্রদেশে চালিত হয় তখন শ্বাসকষ্ট দেখা যায়, নিম্নাঙ্গে গেলে পায়ে খাল ধরে এবং রোগীর অন্ডকোষ কুঁচকাইয়া যায়। প্রেসের কর্মচারীদের পেটের শূলবেদনায় কার্যকরী। সুন্দরী নারীদের শূলবেদনা, বেদনা দেখা দিলেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। তুলনীয়। -ম্যাগ- ফসের শূলবেদনা গরম সেক দিলে উপশম হয়, এটার শূল হঠাৎ আসে হঠাৎ চলে যায়। কলোসিন্থের শূলবেদনা নাভির দিকে চলে আসে; পা গুটাইয়া শুইলে বা শক্ত জিনিষের চাপ দিলে যন্ত্রণার উপশম। ডায়োস্কোরিয়ার শূলবেদনা পিছনের দিকে ঝুঁকলে উপশম, প্লাম্বাম রোগীর শূলবেদনা কিছুতেই উপশম লাভ করে না। প্লাম্বাম সীসক ধাতু, সেজন্য সীসক-শূলে প্ল্যাটিনা, এলুমিনা প্রভৃতি ঔষধ সমধিক কার্যকরী হয়।

কোষ্ঠকাঠিন্য। -কোষ্ঠকাঠিন্যের সময় রোগীর মলদ্বার সঙ্কুচিত হয় এবং আক্ষেপিক বেদনা হতে থাকে। মলত্যাগের নিষ্ফল চেষ্টা। রোগীর মলদ্বার যেন একগাছা দড়ি দ্বারা বাঁধা আছে এবং সরলান্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এরূপ বোধ। পক্ষাঘাত সম্ভাবনাযুক্ত ব্যক্তির কোষ্ঠকাঠিন্যে প্লাম্বাম উপযোগী। এটার মল কাল এবং ছাগলের নাদির মত বড়ি বড়ি (অ্যালুমিনা, কেলি-কা, ম্যাগ-মি, নেট্রাম-মি. ওপিয়াম)।

তুলনীয়।– ওপিয়াম-মল বড়ি বড়ি, সরলাস্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সেজন্য কতক মল বের হয়ে আবার ঢুকে যায়। অ্যালিউমিনা -মলদ্বার-পেশীর স্বাভাবিক ক্রিয়ার অভাবের জন্য তার পাতলা মলত্যাগেও প্রবল বেগ দিতে হয়। অ্যানাকার্ডিয়াম – সহসা মলের বেগ, কিন্তু বাহ্যে মোটেই হয় না, মনে করে তার মলদ্বারে ছিপি আঁটা আছে। সিফিলিনাম -এটার কোষ্ঠবদ্ধতা প্লাম্বামের মত, রোগী মলদ্বারে আঙ্গুল না দিয়ে মল বের করতে পারে না। সাইলিসিয়া-কোষ্ঠবদ্ধতায় অত্যন্ত বেগ দিবার পর মল কতকটা বের হয়েই পুনরায় সেটা উপরদিকে উঠে যায়। অ্যান্ড্রুমেন – রোগিণীর কয়েক দিবস পর্য্যন্ত মলত্যাগের অনিচ্ছা, যখন মলত্যাগ করে, তখন সেটা শক্ত কাল।

পক্ষাঘাত।-পক্ষাঘাতে প্ল্যাম্বামের বিশেষ ক্রিয়া। আক্রান্ত অংশের মাংশপেশী জীর্ণ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রবলভাবে দেখা দেয়। প্লাম্বামের পক্ষাঘাতের বিশেষত্ব এই যে, আক্রান্ত স্থান অবশ না হওয়া পৰ্য্যন্ত হাত ছোঁয়ান যাবে না। এতে হাতের কব্জির পক্ষাঘাত জন্মিয়া রোগীর হাত নিস্তেজ হয়ে ঝুলতে থাকে। পক্ষাঘাতের সাথে রোগীর মাঢ়ীতে একটি নীল দাগ পড়ে। পক্ষাঘাত আরম্ভ হওয়ার পূর্বে শরীরে কম্প হয়; ডাঃ ন্যাস বলেন- পক্ষাঘাতে যখন শরীরে স্পর্শ-দ্বেষ থাকে তখন এই ঔষধের উচ্চতর শক্তি ব্যবহার্য্য। পক্ষাঘাতে জিঙ্কাম, কষ্টিকাম, ল্যাকেসিস প্রভৃতিও উপযোগী (স্ব স্ব অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

মৃগী।– পুরাতন অপস্মার বা মৃগীরোগ। ডাঃ বার্নেট একটি তের বৎসর স্থায়ী মৃগী রোগীকে প্লাম্বাম দ্বারা আরোগ্য করেছিলেন। মৃগীর ফিট হওয়ার পূর্বে রোগীর পা অতিশয় ভারী হয় এবং পক্ষাঘাতের মত আড়ষ্ট হয়। মৃগীর ফিটের পর রোগী নাক ডাকাইয়া ঘুমায়। তুলনীয়।– অ্যাসিন্থিয়াম -মৃগীর ফিট আরম্ভ হওয়ার পূর্বে রোগীর মাথা ঘুরে উঠে, সম্মুখে যেন কি একটা মূৰ্ত্তি দেখতে পায়। কানে শুনতে পায় না, পরে খেঁচুনী আরম্ভ হয়, দাঁত কড়মড় করে, জিব কামড়ায় বলে মুখ দিয়ে রক্তমিশ্রিত ফেনা বের হয়। এতে সম্পূর্ণ জ্ঞানলোপ হয় না। আর্টিমিসিয়া-ঘন ঘন ফিট হয় বলে রোগী জ্ঞানলাভ করার অবসর পায় না। ক্রিমিগ্রস্ত শিশুদের ফিটে উপযোগী। স্ত্রীলোকদের ঋতুসংক্রান্ত গোলযোগ এবং পুরুষদের অতিরিক্ত শুক্রক্ষয়ের জন্য মৃগী। বিউফো- ফিট আরম্ভ হওয়ার পূর্বে রোগী জোরে চীৎকার করে, ফিটের পরে ঘুমিয়ে পড়ে। কিউপ্রাম-মেট- ঘুমন্ত অবস্থায় ফিট হয়। হাঁটু হতে মৃগীর “অরা” (arua) আরম্ভ হয়ে উপরের দিকে যায়।

অন্তকোষের বিষাক্ত ঘা।-অন্ডকোষের গ্যাংগ্রিণ আরোগ্য করতে প্লাম্বামের শক্তি অদ্ভূত। প্লাম্বাম হার্ণিয়া, ইন্টাসা সেসন (অন্ত্রের মধ্যে অন্ত্রাংশ প্রবেশ), প্রস্রাবের রোগ প্রভৃতি রোগে লক্ষণানুসারে উপযোগী।

নিদ্রা।-দিনের বেলা ঘুম ঘুম ভাব, কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রে শূলের জন্য ঘুমের ভিতর চমকিয়ে উঠে, নিদ্রিত অবস্থায় নানাবিধ কথা বলে। প্লাম্বাম-কোষ্ঠবদ্ধতায় ওপিয়াম তুল্য; প্রলাপে-বেলেডোনা তুল্য; মস্তিষ্কের কোমলতায়-জিঙ্কাম তুল্য; মৃগীরোগে-ইগ্নেসিয়া, ল্যাকে তুল্য; স্মৃতিদৌর্বল্যে- অ্যানাকার্ডিয়াম তুল্য।

বৃদ্ধি।– রাত্রিকালে; সন্ধ্যায়; নড়াচড়ায়; হেঁট হলে; স্পর্শে; মানসিক পরিশ্রমে; জনবহুল কক্ষে।

হ্রাস।-ঘর্ষণে; জোরে চাপ দিলে; শারীরিক পরিশ্রমে; খোলা বাতাসে (মাথাঘোরা)।

শক্তি।-৩x চূর্ণ, ৬, ৩০, ২০০

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!