ম্যাগ্নেসিয়া-কাৰ্ব্বনিকা (Magnesia Carbonica)
পরিচয়।-এটার অপর নাম কার্বনেট-অভ-ম্যাগ্নেসিয়া।
ব্যবহারস্থল।-পাকযন্ত্র ও অন্ত্রের রোগ, যথা-অজীর্ণ, উদরাময়, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্রিমি, দুর্বলতা, হনুর নিম্ন প্রদেশে বেদনা, গর্ভাবস্থায় দন্তশূল, বমনেচ্ছা, প্লীহার বেদনা, সর্দি-কাশি, বধিরতা, ঋতুস্রাব, ঋতু বিলম্বে প্রকাশিত হওয়া, জরায়ু হতে রক্তস্রাব প্রভৃতি রোগে কার্যকরী।
ক্রিয়াস্থল।-জীর্ণ-শীর্ণ ব্যক্তিদের উদর ও অন্ত্রের রোগ ক্ষেত্রে, শিশুদের উদরাময় ও রমণীদের ঋতুর নানাবিধ গোলযোগে এবং যাদের লক্ষণাদি প্রতি তৃতীয় সপ্তাহে পুনরাগমন করে তাদের রোগে ক্রিয়াশীল। একটি বিশেষ কথা মনে রাখা কর্তব্য। ম্যাগ্নেসিয়া ঔষধ মাত্রেরই একটি লক্ষণ বেদনা, ঠিক যেরূপ মিউরের ঔষধ মাত্রেই বিশেষ লক্ষণ কোষ্ঠবদ্ধতা।
প্রদর্শক লক্ষণ।-শিশুর গা হতে টক গন্ধ। প্রায়ই ফোঁড়া হয়। দুধ হজম হয় না। দাস্তের পূর্বে বেদনা। মল সবুজ, পানির মত, ফেনা ফেনা। মলে ডিম ডিম, সাদা সাদা চর্বির মত পদার্থ। ঠিক পচা পুকুরের শেওলার বর্ণের মত মল। শিশু দুধ যেমন খায়, মলত্যাগের সঙ্গে সেই অবস্থায় বের হয়ে যায়। পেট হড়হড় গড়গড় করে। ফল, টক ও শাক-সব্জি খেতে চায়। অম্ল, টক ঢেঁকুর, বমিতে জল, তা তিক্ত। মাংস খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। মুখের স্বাদ টক। লালাস্রাব, তাতে রক্ত। গর্ভ অবস্থায় দাঁত বেদনা। রাত্রে বেশী। আক্কেল দাঁত বের হওয়ার সময় কষ্ট। ডান কাঁধে বাত, হাত তুলতে পারে না। নড়াচড়া করার সময় বুকে টাটানি বোধ। গয়ার নোনতা। ঋতুর পূর্বে গলায় ব্যথা। ঋতুস্রাব কাল, চলাফেরায় বন্ধ থাকে। ভাবে মুখমন্ডলে ডিমের সাদা অংশ শুকিয়ে রয়েছে। যন্ত্রণা, বিশ্রামে বৃদ্ধি, উঠতে হয় ও বেড়াতে হয়। বাতরোগ, গরমে উপশম।
গঠন।শিশুর মুখ ফ্যাকাসে, কখনও পৰ্যায়ক্রমে ফ্যাকাসে ও রক্তাক্ত হয় ও তার মুখ এত ফ্যাকাসে হয়ে যায় যেন ডিমের সাদা অংশ কেউ তার মুখে লেপিয়া দিয়েছে। শিশু রাত্রিকালে তার হনূদ্বয় খোঁটে। হনূর নিম্ন প্রদেশ বেদনাযুক্ত হয়ে প্রদাহিত হয়। ডাঃ কেন্ট বলেন-যে সকল শিশু অবৈধ উপায়ে জন্মলাভ করে; যে সকল যুবক-যুবতী গোপন ভাবে রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার পর শিশু উৎপাদন করে, সেই সকল শিশুর মাথার পিছন দিকটা ছোট হয়ে যায় এবং সেটারা জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। ডাঃ কেন্ট একটি শিশু প্রতিষ্ঠানের বহু শিশুকে ম্যাগ্নেসিয়া-কার্বনিকা প্রয়োগে আরোগ্য করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ঐ সকল শিশু অবৈধ উপায়ে জন্মলাভ করেছিল। ম্যাগ-কার্ব শিশুর গাত্র হতে ভয়ানক টকগন্ধ বের হয়-শিশুকে যতই কেন গোসল করান হোক না, তার শরীর হতে টক গন্ধ বের হবেই (হিপার, রিউম, ক্যাল্কেরিয়া, সাফিউরিক-অ্যাসিড)। ডাঃ অ্যালেন বলেন, অল্পে কাতর, কোপন-স্বভাব, শ্লথ তন্তু এবং সর্বাঙ্গে টক গন্ধ বিশিষ্ট শিশুদের পক্ষে ম্যাগ- কার্ব উপযোগী ঔষধ। ডাঃ কুপার বলেন, যে সকল রমণী সংসারের নানা চিন্তায় ও শোক-সন্তাপে ক্ষীণ ও অবসন্ন হয়ে পড়েছে ম্যাগ-কার্ব তাদের শ্রেষ্ঠ ঔষধ ও বন্ধু।
উদরাময়।– ম্যাগ-কার্ব শিশু-উদরাময়ের একটি শ্রেষ্ঠ ঔষধ। শিশুদের সবুজ বর্ণের ফেনাবিশিষ্ট মলে এবং মলত্যাগ করার পূর্বে বেদনায় এই ঔষধ কার্যকরী। এটার বেদনা অনেকটা কলোসিস্থের বেদনার মত। এটার মল ও শরীর হতে ভয়ানক টক গন্ধ বের হয়; রিউম শিশুর বাহ্যে হতেও অত্যন্ত টক গন্ধ বের হয়, কিন্তু রিউমের টক গন্ধ এত যে, শিশুকে সাবান দ্বারা গোসল করালেও তার টক গন্ধ যায় না, কিন্তু রিউমের ক্রিয়া ম্যাগ-কার্বের ক্রিয়ার মত গভীর নয়। ম্যাগ-কার্বের শিশুর উদরাময় প্রতি তিন সপ্তাহ অন্তর ঘুরে আসে-মল, পচা পুকুরের শেওলা যেরূপ ভাসে সেইরূপ। ক্যামোমিলার শিশুও সবুজ বর্ণের মলত্যাগ করে, কিন্তু ক্যামোমিলা শিশুর মানসিক লক্ষণগুলি সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে। স্তন্যপায়ী শিশু যে দুধ পান করে, তাহই অজীর্ণ অবস্থায় মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যায় (গ্যাম্বো, অ্যাব্রো, ক্যাল্কে)। ক্যাঙ্কেরিয়া-কার্ব ও ম্যাগ-কার্ব এই দুই ঔষধেই টক গন্ধযুক্ত মল আছে। উভয় ঔষধেই দুধ সহ্য হয় না, বমি হয় না, বমি হয়ে যায় বা অজীর্ণ দুধ মলদ্বার হতে বের হয়ে আসে, পার্থক্য এই যে-ক্যাল্কেরিয়া শিশুর মাথায়, কপালে ও মুখে প্রচুর ঘাম হয়, শরীরটি থলথলে, পেটটি বড়, পা ঠান্ডা। হিপার-সাল্ফ ঔষধটির মলে টকগন্ধ কিন্তু হিপারে বেদনাশূন্য ও কোথশূন্য। মলের রং প্রায়ই সাদা, সবুজ বা ফিকে হলদে রঙের বাহ্যেও আছে।
কোষ্ঠকাঠিন্য।-রোগীর সরলান্ত্র ও মলদ্বারের আংশিক পক্ষাঘাতবশতঃ এদের স্ব স্ব ক্রিয়ার অভাব। মল শক্ত ও বড়, মলত্যাগ করতে ভয়ানক বেগ দিতে হয়। শক্ত মল বহুখন্ডে বিভক্ত হয়ে অর্থাৎ ভেঙে ভেঙে গুঁড়া হয়ে বের হবে। ম্যাগ-মিউরও এই লক্ষণে বিশিষ্ট ঔষধ-তবে হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত স্ত্রীলোক ও গন্ডমালা ধাতুর শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যেই ম্যাগ-কার্ব বেশী ব্যবহৃত হয়। তুলনীয়।-ম্যাগ্লেসিয়া-মিউর-ছাগলের নাদির মত গাঁট গাঁট মল, তাতে আম জড়িত। অথবা কঠিন বড় গোলার মত শুষ্ক মল, বের হওয়ার সময়ে গুঁড়া হয়ে আসে। নেট্রাম-মিউর শুল্ক বড় ন্যাড়, জোরে বেগ দিতে হয়, তাতে মলদ্বার ফটিয়া রক্ত পড়ে। অ্যালুমেন -দুই চারি দিনের মধ্যে আদৌ বেগই হয় না। যখন হয়, গোল মার্বেলের মত মল। ওপিয়াম-ইচ্ছা বা বেগ থাকে না, যখন হয়, কাল ও শুল্ক গুটলে মল বের হয়। প্লাম্বাম-শক্ত, কাল চাপ চাপ অথবা গুটলে মল। মলদ্বারের সঙ্কোচন। স্যানিকিউলা-বড় ন্যাড় মল, অত্যন্ত বেগ দিতে হয়। মলদ্বারে বেদনা, পেটে বেশী পরিমাণে মল জমা না হলে বেগ আসে না।
শিশুরোগ।-গন্ডমালা বা ভ্রুফুলা ধাতুবিশিষ্ট অত্যন্ত শীর্ণ শিশু, দুধ যাদের মোটেই হজম হয় না, যাদের মল সবুজবর্ণের এঁদো পুকুরের শেওলার মত, শরীর কিছুতেই মোটা হয় না, ক্রমেই জীর্ণ-শীর্ণ হতে থাকে, মুখ ঘায়ে পূর্ণ থাকে, সেই সকল শিশুদের পক্ষে এই ঔষধ ফলপ্রদ। যে সকল শিশু যক্ষ্মারোগপ্রবণ জননীর সন্তান তাদের শীর্ণতা বা পুঁয়ে পাওয়া (ম্যারাসমাস) রোগে এটা কার্যকরী ঔষধ। তুলনীয়।-সমস্ত শরীরের শীর্ণতার লক্ষণানুসারে ব্যবহৃত হয়- অ্যাব্রোটেনাম, আয়োডিন, সেফিলিনাম। নিম্নাঙ্গের শীর্ণতা-অ্যাব্রোটেনাম, আয়োডিন, স্যানিকুলা, টিউবারকুলিনাম। ঊর্ধ্বাঙ্গের-লাইকোপোডিয়াম, নেট্রাম মিউর, সোরিণাম। গলার দিকে নেট্রাম- মিউর, স্যানিকুলা।
স্নায়বিক শূলবেদনা।-অন্যান্য ম্যাগ্লেসিয়ার মত এটারও ভয়ানক স্নায়বিক শূল আছে। বেদনায় সে স্থির থাকতে পারে না, অনবরত পায়চারি করে বেড়ায়, এমন পায়চারি করলে শূলবেদনার উপশম। ম্যাগ-ফসের শূলবেদনায় গরম সেক দিলে ও সম্মুখের দিকে ঝুঁকে পড়লে উপশম। এটার স্নায়ুশূল মাথায় ও মুখেই অধিক হয়। রাতে এটার শূলবেদনার বৃদ্ধি হয়।
এবার স্ত্রীরোগ।– ঋতু বিলম্বে প্রকাশিত হয় ও ঋতুস্রাব খুবই কম হয়। অকালে ঋতু হয়, ঋতুস্ৰাৰ কেবলমাত্র রাত্রে বা শয়নাবস্থায় হয়, চলাফেরা করলে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় (অ্যামন- মিউর; কেবলমাত্র দিবাভাগে স্রাব হয় এবং শয়ন করলেই কমে যায় (ক্যাক্টাস ও লিলিয়াম)। ম্যাগ- কার্ব রোগিণীর ঋতুস্রাব আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই তার সর্দি ও গলায় ব্যথার আবির্ভাব হয় (গ্র্যাফা), যথাসময়ের পূর্বেই বেগে ঋতুস্রাবের আবির্ভাব হয় (বোভিষ্টা, অ্যামন-কার্ব)। ঋতুর সময় প্রসব বেদনার মত বেদনা, অত্যন্ত শূলের মত বেদনা; ম্যাগ্নেসিয়ার মাসিক ঋতুর রক্ত আলকাতরার মত কাল।
দন্তশূল।– গর্ভবতীদের দন্তশূল! এই বেদনা রাত্রে বেশী হয় এবং ঘুরে বেড়ালে বেদনার উপশম। আক্কেল দাঁত উঠার সময় যে ভয়ানক কষ্টকর দন্তশূল দেখা দেয় তাতে ম্যাগ-কার্ব উত্তম। রোগী শয্যা ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়। গর্ভবতীদের দন্তশূলে তুলনীয়-ক্যাল্কেরিয়া- ফ্লোরিকা, ক্যামোমিলা, কফিয়া, ক্রিয়োজোট, র্যাটানহিয়া, ষ্ট্যাফিসেগ্রিয়া, ট্যাবেকাম।
কাশি। টিউবারকুলার রোগীদের শুষ্ক আক্ষেপিক কাশি। সন্ধ্যার পূর্বে শুষ্ক কাশি এবং রাস- টক্সের মত শীত শীত ভাব। এমন অনেক লোক দেখা যায় বৎসরের পর বৎসর সামান্য শুষ্ক কাশিতে ভুগতে থাকে। তারা এই জাতীয় কাশিকে বিশেষভাবে নজরের মধ্যে আনে না, কিন্তু এমন একটা সময় এসে উপস্থিত হয় যে, এই সামান্য কাশি যা পূর্বে সে অবহেলা করে এসেছে তাই প্রবল আকার ধারণ করে টিউবার্কিউলার কাশিতে পরিণত হয়েছে। সেই জাতীয় কাশির জন্য আর্সেনিক, ক্যাল্কেরিয়া-কার্ব, লাইকোপোড, ম্যাগ-কার্ব ও টিউবারকুলিনাম ঔষধ। হ্যানিমান ইহাদিগকে one sided রোগ বলে অ্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। ম্যাগ-কার্বের রোগিণী সমস্ত দিন ঘুমিয়ে কাটায় বা তার ঘুম-ঘুম ভাব থাকে, কিন্তু সমস্ত রাত্রি অনিদ্রায় অতিবাহিত করে। গয়ার অত্যন্ত দূর্গন্ধময়, মটরাকৃতি শ্লেষ্মাগুটি মিশ্রিতাবস্থায় থাকে। ম্যাগ-কার্বের ক্ষয়কাশি রোগীর মাংস খাওয়ার অত্যধিক লালসা।
বাতরোগ।-ডান স্কন্ধাস্থির বাতরোগে ম্যাগ-কার্ব ফলপ্রদ ঔষধ। ম্যাগ-কার্বের বেদনা কিছুক্ষণ চলে যাবার পর বাড়ে, গরম সেক দিলে উপশম হয়। শয্যার উত্তাপে বাড়ে। স্যাঙ্গুইনেরিয়া ঔষধের সাথে এটার বিশেষ সাদৃশ্য আছে। স্যাঙ্গুইনেরিয়া ডান কাঁধের বাতের বেদনায় বিশেষ ফলপ্রদ। ঘাড়ে বাতের বেদনা। ম্যাগ-কার্বের বেদনা গরম সেক দিলে কমে কিন্তু শয্যার উত্তাপে বাড়ে। স্যাঙ্গুইনেরিয়ার বেদনা সঞ্চালনে, পার্শ্ব-পরিবর্তনে ও রাতে বাড়ে এবং স্থিরভাবে শুয়ে থাকলে, জোরে টিপলে, বামপার্শ্বে শয়নে, নিদ্রার পরে ও নির্মল বায়ুতে কমে।
নিদ্রা।-ম্যাগ-কার্বের রোগীর অতৃপ্ত নিদ্রা, শয়নের সময় অপেক্ষা ঘুম ভাঙ্গিবার সময় তার অবসাদ বোধ বেশী। রোগী বলিবে ডাক্তারবাবু, সকালবেলা আমি এত বেশী দুর্বল ও অবসন্ন হয়ে পড়ি যে, মনে হয় যেন আমার রাত্রে মোটেই নিদ্রা হয় নেই। রাত্রি ২/৩ টার সময় ঘুম ভেঙে আর ঘুম হয় না। চোর, ডাকাত, আগুন, বন্যা প্রভৃতির স্বপ্ন দেখে চমকিত হয়ে বা ক্রন্দন করিযা উঠে।
সম্বন্ধ।-ম্যাগ-কার্ব টকগন্ধযুক্ত মলে-রিউম, ক্যাল্কে তুল্য; পেটের শূলবেদনার ম্যাগ-ফস ও কলোসিন্থ তুল্য; স্নায়ুশূলে-ক্যামো ও ম্যাগ-ফস তুল্য। কোষ্ঠকাঠিন্যে ম্যাগ-মিউর, প্লাম্বাম তুল্য; ঋতুস্রাবে-অ্যামন-মিউর তুল্য।
বৃদ্ধি।-বিছানার গরমে; ঋতু পরিবর্তনে; ঠান্ডা বায়ুতে; শীতকালে; শয়নে; রাতে; দুধ পান করলে; ঠান্ডার বায়ু-প্রবাহে; প্রতি তৃতীয় সপ্তাহে; স্পর্শে; চাপে; ধূমপানে।
হ্রাস।-গরম বায়ুতে; খোলা বাতাসে বেড়ালে; উত্তাপে।
শক্তি।-৩, ৬, ৩০, ২০০ বা তদূর্ধ্ব শক্তি।