লাইকোপোডিয়াম (Lycopodium)

পরিচয়।– -এটার অপর নাম ক্লাব-মস। এটা পার্বতীয় একপ্রকার শেওলা জাতীয় গুল্ম। লাইকোপোডিয়াম-মস দার্জিলিং পাহাড়েও পাওয়া গেছে। সেটার শাখার স্পাইকগুলির মধ্যে হলুদবর্ণের অতি কোমল, অতি সূক্ষ্ম চূর্ণবৎ রেণু থাকে। ঐ রেণুগুলি খলে মর্দন করে সুরাসার মিশিয়ে কাদার মত করতে হয়। অতঃপর ৫ গুণ সুরাসার মিশ্রিত করে মাদার-টিংচার তৈরী হয়। হানেমান বহু সতর্কতার সাথে লাইকোপোডিয়াম প্রুভিং করে গেছেন।

ব্যবহারস্থল।-লাইকো অ্যান্টিসোরিক, অ্যান্টিসাইকোটিক ও অ্যান্টিসিফিলিটিক ঔষধ। এটা যে কত কার্যকরী ঔষধ এবং কত রোগী যে এই অমৃত তুল্য ঔষধের কৃপায় আরোগ্য লাভ করেছে তা ব্যক্ত করা যায় না। বস্তুতঃ লাইকো একটি গভীর ক্রিয়াশীল ঔষধ। কোষ্ঠকাঠিন্য, অজীর্ণ, রক্তামাশয়, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ক্ষয়কাশি, ফুসফুস-প্রদাহ, পাথরী, মূত্রাশয়-মুখশায়ীগ্রন্থি-প্ৰদাহ, পিত্তশিলা, পিত্তশূল, হৃৎশূল, ক্যান্সার, খিলধরা, ডিফথিরিয়া, শোথ, নাক দিয়ে রক্তপাত, বাধক, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, জরায়ু হতে বায়ু বের হয়, গলগন্ড, মূৰ্চ্ছাবায়ু, ধ্বজভঙ্গ, কামোন্মাদ, সান্নিপাতিক- জ্বর, ম্যালেরিয়া-জ্বর, পক্ষাঘাত, আঙ্গুলহাড়া, অন্ত্র-প্রদাহ, কর্ণশূল, তোতলামি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গলক্ষত, ক্রিমি, হৃত্যন্ত্রের রোগ, অর্শ, রক্তমূত্র, বুকজ্বালা, চোখের বিভিন্ন রোগ, মুখ দিয়ে পানি উঠা, হুপিং-কাশি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কার্যকরী ঔষধ। লাইকোর রোগলক্ষণ ধীরে ধীরে বর্দ্ধিত হয়। লিভারের দোষ পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান থাকে।

ক্রিয়াস্থল।-পরিপাক-যন্ত্র, জননযন্ত্র ও মূত্রযন্ত্র এবং শ্বাসযন্ত্রের শ্লৈষ্মিক-ঝিল্লীর উপর এটার ক্রিয়া দেখা যায়। চর্ম ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর উপর এটার ক্রিয়াধিক্য সন্দেহ নেই, কিন্তু যকৃৎ ও পরিপাকার্থেই এটার ক্রিয়া বেশী, এটার ফলে পরিপাক ক্রিয়ার ব্যাঘাত, যকৃতে রক্তসঞ্চয় ও কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হয়। মূত্রে লিথিক-অ্যাসিড জন্মিয়া কিডনী ও মূত্রাশয়াদিতে বেদনা জন্মে।

মন।-লাইকোপোডিয়াম শিশু অত্যন্ত ক্রোধী, সামান্য কারণে খিটখিট করে, রেগে যায়, লাথি ছোঁড়ে ও চীৎকার করতে থাকে, সে প্রতিবাদ সহ্য করতে পারে না (অরাম, ব্রাইও, নাক্স)। রোগী একাকী থাকতে ভয় পায়, তার স্মৃতিশক্তির অভাব। ডাক্তার, মন্ত্রী, উকিল যাঁহাদের জনসাধারণের ভিতর কাজকর্ম বক্তৃতাদি করতে হয়, তাঁহারা অনেক সময় বক্তৃতা করতে বা এজলাসে উঠে মামলাদির কথা বলতে ভয় পান, কিন্তু কোন প্রকারে যদি তাঁহাদিগকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে তাঁহারা রীতিমত বক্তৃতাদি করতে থাকেন, এমন রোগীক্ষেত্রে লাইকো বিশেষ উপযোগী; এই লক্ষণ সাইলিসিয়া রোগীতেও দেখা যায়। লাইকো রোগী খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু আত্মশক্তিতে বিশ্বাসহীন। অথচ একবার তাকে নিজের কার্য্যের ভিতর ঢুকাইয়া দিলে সে পূর্ণ উদ্যমে আপন কাজ করে যাবে। লাইকো রোগীর ধর্মভাব উগ্র হতে উগ্রতর হয়ে পরিণামে সে ধর্ম-পাগল হয়ে দাঁড়ায়। লাইকোরোগী অত্যন্ত ক্রন্দনশীল (পালস) কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হলে সে কাঁদিয়ে ফেলে। সামান্য একটুকু দুঃসংবাদ পেলে কাঁদিয়ে অস্থির হয়, সামান্য আনন্দ সংবাদেও সে কাঁদিয়ে ফেলে, লাইকো রোগীকে কেউ ধন্যবাদ দিলেও সে কাঁদে। পীড়িত অবস্থায় সে নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। উত্তেজিত ভাবে আদেশ দেয়।

প্রদর্শক লক্ষণ।-রোগ শরীরের ডানদিকে আরম্ভ হয়। ডানদিক হতে বামদিকে যায়। বিকাল ৪টা হতে রাত্রি ৮টার মধ্যে রোগলক্ষণ বৃদ্ধি পায় (হেলিবোরাস, কলোসিন্থ)। রোগীর ক্ষুধা খুব, কিন্তু অল্প কিছু আহার করামাত্রই রোগী ভাবে সে যেন কতই খেয়েছে, পেট ভরে যায়, আর খেতে পারে না। অম্লরোগ, অজীর্ণ রোগ, বুক-জ্বালা, গলা-জ্বালা, পেটে বায়ুসঞ্চয়, পেটফাঁপা, পেটে ভুটভাট। উদর-যন্ত্রের বিশৃঙ্খলা। কোষ্ঠকাঠিন্য, মল শক্ত, পরিমাণে অল্প, কষ্টের সাথে বের হয়। প্রথমে শক্ত ডেলা-ডেলা মল, তারপর নরম মল বের হয়। মলত্যাগের পর মনে হয় দাস্ত পরিষ্কার হইল না। (নাক্স-ভমিকায় অনবরত মলত্যাগের ইচ্ছা থাকে, রোগী পায়খানায় যায়, কিন্তু বাহ্যে পরিষ্কার হয় না, রোগী মনে করে আর একটু বাহ্যে হলে ভাল হইত। অ্যালুমিনায় সরলান্ত্রের ক্রিয়াহীনতা লক্ষিত হয়, যাহার জন্য নরম বাহ্যে হলেও জোরে কোঁথ দিতে হয়। এটা ব্যতীতও ভীষণ কোষ্ঠবদ্ধতা আছে, যে পৰ্য্যন্ত না পেটে খুব বেশী পরিমাণে মল জমে ততদিন আদৌ বাহ্যেই হয় না, মলত্যাগের জন্য কোনপ্রকার চেষ্টাও থাকে না। মলত্যাগ করার সময়ে জোরে বেগ দিতে হয়, শক্ত গাঁট-গাঁট আমজড়িত মল বের হয়)। শরীরের উপরের অংশ শীর্ণ, নীচের অংশ ফোলা। শিশুরা সমস্তদিন কাঁদে এবং রাত্রে বেশ ঘুমায় (কিন্তু জেলাপা-শিশু দিন-রাত্রিই কাঁদে অথবা প্রায়ই এমন দেখা যায়। তারা দিনের বেলায় শান্তই থাকে ও রাতে চীৎকার করে কাঁদে। এদের মূল টকগন্ধযুক্ত। সাইপ্রিপেডিয়াম শিশু দিনের বেলায় ভালই থাকে, হাসে, খেলা করে, রাত্রি হলেই চীৎকার শুরু করে দেয়, কান্নাকাটি করে বাড়ীর লোককে বিরক্ত করে তোলে)। ভয়, ক্রোধ, অপমান বা বিরক্তি হতে রোগের উৎপত্তি। প্রস্রাবে লালবর্ণের তলানি। শিশু প্রস্রাবের পূর্বে কাঁদিয়ে উঠে, ঘুম হতে উঠে হাত-পা ছোঁড়ে। হার্ণিয়ারোগ, বিশেষতঃ ডানদিকে এবং বিশেষভাবে শিশুদের। যোনিপথ শুষ্ক, সঙ্গমের সময় ও পরে যোনিতে জ্বালা করে। যোনি হতে সশব্দে বায়ু নিঃসরণ (ব্রোম, অ্যাসিড-ফস)। নিউমোনিয়া, বিশেষতঃ ডানদিকের। নাক-পক্ষ উঠা-নামা করা, ৪টা হতে ৮টায় বৃদ্ধি (এন্টিম-টার্ট, ফস, চেলিডো, আয়োড)। জিহবা ক্লেদযুক্ত। নাক বন্ধ, নাক সেঁটে ধরার জন্য শিশু চমকিয়ে উঠে, ঘুম ভেঙে যায়। উঠে নাক রগড়াতে থাকে। নিউমোনিয়ায় নাকের পাখাদ্বয় উঠা-নামা করে। শুষ্ক কাশি সেইসঙ্গে শরীরের ক্ষয় ও দুর্বলতা। ধ্বজভঙ্গ, বিশেষতঃ বৃদ্ধদের। হস্তমৈথুন বা অতিরিক্ত শুক্রক্ষয় বা রতিক্রিয়া জনিত ধ্বজভঙ্গ। লিঙ্গাগ্র ক্ষুদ্র, ঠান্ডা ও শিথিল। প্রতিবার মলত্যাগের সময় জননেন্দ্রিয় হতে রক্ত পড়ে। একটি পা গরম ও অন্যটি ঠান্ডা (চায়না, ডিজিটেলিস, ইপিকাক)। নিউমোনিয়া ভালরূপ চিকিৎসা হয় নেই, তজ্জন্য নিউমোনিয়া ধীরে ধীরে থাইসিস বা যক্ষ্মারোগে পরিণত হয় (কার্বো-ভেজ)। যা খায় তাকে টক স্বাদ। মুখমন্ডল কুঞ্চিত। শব্দ বা উগ্র গন্ধ সহ্য হয় না। সকালে দুর্বলতা, বিষণ্নভাব। উদরে শোথ, সেইসঙ্গে লিভারের রোগ।

স্বভাব ও গঠন।– যাঁহাদের দেহ শীর্ণ ও ক্ষীণ কিন্তু মনটি সুবিকাশিত, যাদের শরীরের উপরের দিক শীর্ণ এবং নীচের দিকটা মোটা, দেখিলে মনে হয় যেন শোথ হয়েছে। নেট্রাম- মিউরে প্রথমতঃ শিশুর গলা শীর্ণ হয় তারপর অপরাপর স্থান। যে সকল শিশুর মাথাটির আকার ঠিকমত আছে অথচ দেহ রুগ্ন, শীর্ণ এবং যাদের পেটে প্রায়ই বায়ু জমে ও অজীর্ণরোগে ভোগে, কিন্তু বুদ্ধি বিকাশ উত্তমরূপে হয়, তাদের পক্ষে এই ঔষধ ব্যবহার্য্য। লাইকোর শিশু সারাদিন কাঁদে কিন্তু রাত্রে ঘুমায়। জেলেপা ও সোরিণাম শিশু সমস্ত রাত্রি কাঁদে ও সমস্ত দিন ঘুমায়। লাইকো শিশু ও বৃদ্ধগণের প্রকৃষ্ট ঔষধ। এটার রোগী গরম খাদ্যই পছন্দ করে (চেলিডো-অত্যন্ত গরম খাদ্য চায়)।

মাথাধরা ও শিরঃরোগ।-প্রাতভোজনের পর মাথাধরা। কাশির পর মাথায় দপদপানি ব্যথা। মাথার ঢাকা খুলে দিলে মাথার যন্ত্রণা কম হয় (সাদার) মাথার পশ্চাৎদিকে ব্যথা, খোলা হাওয়ায় গেলে কম হয়। লাইকো রোগীর এই মাথার যন্ত্রণা অজীর্ণরোগের জন্য হয়ে থাকে। যদি তার খাওয়ার সময় হয়ে যায় তা হলে মাথার যন্ত্রণা আরম্ভ হবে (সাম্ফ)। এখানে ক্যাক্টাস ঔষধটি তুলনীয় -লাইকো রোগী কিছু আহার করলে মাথার যন্ত্রণা কমে যায়, কিন্তু ক্যাক্টাসে আহার করলে যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। লাইকোপোডিয়াম রোগীর যেমন শিরঃরোগ বিদ্যমান থাকে সেইরূপ রোগীর মাথার পশ্চাৎদিকে নানারকম উদ্ভেদ বের হয়ে চুল উঠে যায়। সেটা হতে সামান্যতেই আঠা আঠা দ্রব্য পড়তে থাকে। কানের পশ্চাৎ হতে কাউর (একজিমা) মাথা পৰ্য্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শিশুদের একজিমার জন্য লাইকো অতি উত্তম ঔষধ। যে সকল শিশু মুহুর্মুহূ ক্ষুধায় কাতর হয়, যারা দেখতে অত্যন্ত রুগ্ন, যাদের প্রায়ই মাথার যন্ত্রণা থাকে, যাদের প্রস্রাবে ইঁটের গুঁড়ার মত লালবর্ণের পদার্থ তলানি পড়ে, তাদের মাথার একজিমা রোগে লাইকো একটি অমূল্য ঔষধ। চুলউঠাও এই ঔষধে দেখা যায়, পেটের নানাবিধ রোগ ও প্রসবের পর যাদের চুল উঠে, মাথার চামড়ার ভিতর জ্বালা ও সেখানে অত্যন্ত চুলকানি ও চুলের অকাল-পক্কতা ও টাকের জন্য লাইকো একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ (ক্যাম্ফ, গ্র্যাফা, অ্যাসিড-ফস)।

অজীর্ণরোগ।-পেটফাঁপা (কার্বো-ভেজ, চায়না)। লাইকোর পেটের মধ্যে অনবরত বায়ু ভুটভাট, কোঁ-কোঁ, গুড়-গুড় শব্দ হয়। চায়নায় সমস্ত পেট বায়ুতে ফুলে উঠে। কার্বো-ভেজে উপর পেট ফোলে এবং লাইকোতে নীচের অংশ ফোলে। পেটফাঁপার মূলে লিভারের রোগ বৰ্ত্তমান থাকে। বায়ু নীচের দিকে না নেমে উপর দিকেই উঠে। Splenic flexure of the Colon-এ বায়ুর গড়গড় শব্দ। অন্ত্রের ঐ অংশ ফুলে উঁচু হয়ে উঠে। রোগীর অত্যন্ত ক্ষুধা, খাওয়ার পূর্বে মনে করে অনেকটা ভাত বা রুটী বা যে কোন খাদ্য সে খেয়ে ফেলিবে এবং খাওয়ার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে, কিন্তু দুই-এক গ্লাস ভাত বা অল্প এক টুকরা রুটী আহার করামাত্র তার আর ক্ষুধা থাকে না। নাক্স-ভমিকার রোগীরও কিছু খেলে এমন পেট ভরে উঠে, তবে লাইকোতে আহার করামাত্রই এরূপ হয়, আর নাক্সে কিছুক্ষণ পরে, লাইকো ও নাক্সে মলত্যাগের পর মনে হয় বাহ্যে পরিষ্কার হইল না, কিছু মল ভিতরে হতে গেল। লাইকোতে মল প্রথমে শক্ত পরে নরম, নাস্ত্রে এরূপ নয়। নাক্সে বার বার মলত্যাগের বেগ আসে। মিষ্টদ্রব্য খেতে ইচ্ছা। খাদ্যবস্তুতে টক আস্বাদ, টক ঢেঁকুর, টক বমি। বুক-জ্বালা, গলা-জ্বালা। শামুক, ঝিনুক, চিংড়ী মাছ, কাঁকড়া প্রভৃতি খেয়ে অজীর্ণরোগ। অসম্পূর্ণ ঢেঁকুর, গলা পর্যন্ত উঠে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বলে। খাদ্য ও পানীয় গরম খেতে চায়। চেলিডোর পেটের ব্যথা নীচের পেটে, একদিক হতে অন্যদিকে যায়। ডানদিকে উঠে বাঁদিকে যায়। মুখে তিৎ স্বাদ। পেট ফুলে উঠে, হাত দিতে দেয় না, কাপড় ঢিলা করতে হয়। বায়ু বের হতে না পারায় পেটে যন্ত্রণা। ঢেঁকুর উঠলে পেটফাঁপা কিছু কমে, কিন্তু কষ্ট বোধ কিছুমাত্র কম হয় না। কার্বো-ভেজে ঢেঁকুর উঠলে সকল কষ্টই কম হয়। রুদ্ধ বায়ুতে পেট ফুলে উঠে, হাঁপানির ভাব। সকল কষ্ট বেলা ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত বেশী হয়। পেটের মধ্যে বায়ু তাল পাকাইয়া ঘুরে বেড়ায়, এটা অনেক সময় শক্ত ডেলার মত গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়ায়। সালফারও লাইকোর মত পেটফাঁপায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে পেটে বায়ু জমে। মুখের স্বাদ টক বা তিক্ত। তবে সাম্ফারে বিশেষ করে Sgmoid flexure স্থানে (স্থূলান্ত্রের দ্বিবক্র ভাঁজ- Colon where the rectum commence) বায়ু জমে। রোগী বলে তার বাম কুঁচকির স্থানে বায়ু জমেছে। সাল্ফারে লাইকোর অনেক লক্ষণ থাকে, তবে সাম্ফারের রোগী বাহ্যে পেলে অপেক্ষা করতে পারে না। তৎক্ষণাৎ বাহ্যে যেতে হয় নচেৎ কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। তুলনীয়।– কেলি-কার্ব-পেটফাঁপা, মিষ্টি খেতে চায়। বৃদ্ধদের অজীর্ণ, অম্ল, বুক-জ্বালা, পেট ফোলা, বরফ-পানি খেয়ে রোগ। টক ঢেঁকুর, গা-বমি-বমি, শুয়ে থাকলে কম থাকে। যা খায় বা পান করে সবই বায়ুতে পরিণত হয়। মোমডিকা-বালসাম – উপর পেটের বায়ুতে (splenic llexure) লাইকো দ্বারা উপকার হয়। র‍্যাফেনাস -প্লেট বায়ুতে পরিপূর্ণ, কিন্তু কোন দিক দিয়েই বায়ু বের হয় না। পেট শক্ত বোধ। মলের মত পদার্থ বমি হয়। গ্রাফাইটিসে পেট বায়ুতে পরিপূর্ণ হয়ে ফুলে উঠে। সামান্য পরিমাণ খাদ্য খেলেও পেট ভরে যায়। পেট শক্ত হয়ে যায়। বায়ুতে পেট ভরা ও শক্ত। যেদিকে শোথ তার বিপরীত দিকে বায়ুজনিত পেট ব্যথা।

কোষ্ঠকাঠিন্য।রোগ যখন মলদ্বারের আকুঞ্চন বশতঃ হয়, তখন লাইকো উপযোগী। মলের বেগ হয়, কিন্তু মল বের হয় না, নাক্স ভমিকার রোগীর মত সর্বক্ষণই মলবেগ, কিন্তু অতৃপ্ত মলত্যাগ, বেশ খোলসা মলত্যাগ করে না। ব্রাইওনিয়ায় মোটেই মল-প্রবৃত্তি থাকে না, যদি বহু চেষ্টায় মলত্যাগ করে, তবে সেটা শুষ্ক, শক্ত ও পোড়া-পোড়া। ওপিয়াম, অ্যালুমিনা, প্লাম্বাম প্রভৃতিও কোষ্ঠকাঠিন্যে অবস্থাভেদে বা লক্ষণানুসারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে (স্ব স্ব অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

হাঁপানি রোগ।– হাঁপানি-কাশিতে লাইকো বিশেষ উপকারী ঔষধ। পেটের গোলমালের জন্য হাঁপানি, সেইসঙ্গে পেটফোলা (চায়না)। দিনে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সাঁই-সাঁই শব্দ, বুকে প্রচুর মিউকাস বা সর্দি, সর্দি ঘড়ঘড় করে। হাঁপানি, খোলা বাতাসে, পিঠের উপর শুইলে ও বদ্ধ গরম ঘরে বৃদ্ধি পায়। সিঁড়ি দিয়ে একটু উঠলেই হাঁপিয়ে পড়ে (আর্স)। বেলা ৪টা হতে ৮টার মধ্যে সকল কষ্ট বাড়ে। অজীর্ণ লক্ষণ বৰ্ত্তমান থাকবেই। রাত্রে শোয়ার পর কাশি (ফস, সাইলি), অনবরত কাশি।

ক্যাপিলারী-ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া। -এটা সাধারণতঃ শিশু ও বৃদ্ধদের রোগেই বেশী প্রযোজ্য। লাইকোর নিউমোনিয়া ডানদিক হতে আরম্ভ হয়ে বামদিকে চলে যায়, আর ল্যাকেসিস রোগীর বামদিক হতে আরম্ভ হয়ে ডানদিকে চলে যায়। রোগীর বুকের ডানদিক বা আক্রান্ত অংশ যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করলে উচ্চশব্দবিশিষ্ট ঘড়ঘড়ানি শুনা যায়। নিউমোনিয়া রোগী মুখভর্তি মরিচা রঙের গয়ার তুলে, গয়ার বা শ্লেষ্মা কতকটা পুঁজের মত। বিকাল ৪টা হতে রাত্রি ৮টার ভিতর রোগের বৃদ্ধি। ব্রঙ্কাইটিসের সাথে জ্বর থাকে এবং শিশুর নাকের পাতা উঠা-নামা করে। লাইকো ব্রঙ্কাইটিসের দ্বিতীয় অবস্থায় ব্যবহৃত হয়। নিউমোনিয়ার দ্বিতীয় অবস্থায়ও এটা খুব কার্যকরী ঔষধ। যে সকল নিউমোনিয়া রোগী প্রথম হতে উত্তমরূপে চিকিৎসিত হয় না বা নিজের অসাবধানতার জন্য রোগ কঠিন আকার ধারণ করে, সেই সকল ক্ষেত্রে লাইকো উৎকৃষ্ট ঔষধ। যখন ফুসফুস যকৃৎ ভাবাপন্ন হয় তখনও লাইকো চমৎকার কাজ করে। টাইফয়েডযুক্ত নিউমোনিয়া রোগ-লক্ষণ যথা, ৪টা হতে রাত্রি ৮টায় বৃদ্ধি, ডান ফুসফুস আক্রান্ত হওয়া, পেট ফেঁপে উঠা প্রভৃতি ক্ষেত্রে লাইকো কার্যকরী। হেপাটাইজ্বেসন, শ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্ট। নাক পক্ষের সঙ্কোচন ও প্রসারণ (অ্যান্টিম- টার্ট, ফস্ফোরাস, চেলিডো) এবং নিউমোনিয়ার সাথে টাইফয়েড লক্ষণে এটা প্রযোজ্য। যে সকল নিউমোনিয়ায় ভাল চিকিৎসা হয় নেই এবং তার ফলে যক্ষ্মা হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। কাশি প্রভৃতি সকল লক্ষণই বেলা ৪টা হতে ৮টার মধ্যে বৃদ্ধি পায়। দুই কাঁধের মধ্যস্থলে জ্বালা (ফস্ফোরাস, সাম্ফার)। ফস্ফোরাসে বামদিকে শুইতে পারে না। সাঙ্কারে পায়ের তলায় জ্বালা, ঠান্ডা জায়গায় পা রাখে বা লেপের ভিতর হতে পা বের করে রাখে। চেলিযোনিয়ামের সাদা মল, হলদে প্রস্রাব ও কাঁধের নীচে ডানদিকে যন্ত্রণা। লাইকোর গয়ার ধূসরবর্ণ, মুখ ভরে উঠে, লোহার মরিচার মত রং, গাঢ় নয়, চটচটে, সহজে ছেড়ে যায়, কোথাও লেগে থাকে না। নোনতা গয়ার (আর্স, ফস, পালস), রং সাদা। হলদে পুঁজের মত গয়ার। রক্তময় গয়ার। সবুজ গয়ার, সকালে সবুজ গয়ার। বুকে সর্দি ঘড়ঘড় করে।

সর্দি ও কাশি। দিবারাত্র শুষ্ক কাশি। ৪টা হতে ৮টা পৰ্য্যন্ত কাশি হয়। বামদিকে শুইলে কাশি। কাশির জন্য পেটে ব্যথা। নীচে নামিবার সময় কাশি। নোনতা গয়ার। বুকে সর্দির ঘড়ঘড় শব্দ (অ্যান্টিম-টার্ট)। শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস। সর্দিতে নাক বন্ধ, বিশেষতঃ রাত্রে। শিশু চমকিয়ে উঠে, ঘুম ভেঙে যায় ও নাক রগড়ায়। নাকের ভিতর ঘা। কাশবার সময় দাঁতে ব্যথা (কেলি-বাই)। কখনও একদিন অন্তর কাশির বৃদ্ধি। পাকযন্ত্রের উত্তেজনা হেতু হাঁপানিযুক্ত কাশিতে, বিশেষতঃ সেই সাথে পেটফাঁপা থাকলে এটা ফলপ্রদ। তুলনীয়। -জিঞ্জিবার – পাকস্থলী এবং স্বরযন্ত্রের উত্তেজনা হেতু কাশি এবং হাঁপানিতে বিশেষ ফলপ্রদ, পাকস্থলী ভারি মনে হয় যেন, সেটাতে পাথর পোরা রয়েছে। বমি এবং গা-বমি-বমি লক্ষণ থাকে, সন্ধ্যা হতে বৃদ্ধি।

যকৃতের রোগ।– যকৃতের সিরোসিস রোগ। সেইসঙ্গে উদরী, বিশেষতঃ মাতালদের। জিন – লিভার। কোন রকম অপমান বা বিরক্তি জনিত লিভার বা যকৃৎ রোগ। পুরাতন যকৃৎ রোগ। লিভারে ফোঁড়া। যকৃৎ শুকিয়ে যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য, মল শক্ত, পরিমাণে অল্প, কষ্টে বের হয় মলদ্বার সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য মল বের হতে পারে না। মলত্যাগের পর মনে হয় বাহ্যে পরিষ্কার হইল না, আরও মল ভিতরে হতে গেল। মল প্রথম দিকে শক্ত, শেষের দিকে নরম বা পাতলা। বামদিকের হাইপোকনড্রিয়ামে বায়ুর গড়গড়, হড়হড়, কোঁ-কোঁ শব্দ। রোগী যখন ডান পাশে ফিরে শোয় তখন তার মনে হয় একটি শক্ত পদার্থ নাভির কাছ হতে গড়িয়ে ডানদিকে যায়। ঘোলা দুধের মত সাদা প্রস্রাব, লাল রঙের তলানি পড়ে। ঘুম-ঘুম ভাব ও ক্লান্তি। সকালে ঘুম হতে উঠবার পর মুখে টক বা পচা স্বাদ। জিহবায় ময়লা। ক্ষুধা, কিন্তু সামান্য কিছু আহার করামাত্র পেট ভরে দমসম হয়ে যায়, যেন অনেক আহার করা হয়েছে। সর্বদা লিভারের জায়গায় একঘেয়ে বেদনা। কোমরে কাপড় রাখতে পারে না (ল্যাকে)। তুলনীয়।-লাইকো ও চেলিডো সদৃশ ঔষধ। চেলিডোর রোগীরও পেটে অত্যন্ত কষ্টদায়ক বেদনা আছে, সময় সময় পেটে খোঁচা মারে, রোগী অত্যন্ত গরম জিনিষ খেতে চায়। চেলিডোর বিশেষত্ব, পিঠের ডানদিকের কাঁধের নীচে বেদনা। এটার রোগীর শরীর, প্রস্রাব ও মল অত্যন্ত হরিদ্রাবর্ণের হয়। লাইকোর রোগলক্ষণ বিকাল ৪টা হতে রত্রি ৮টায়। চেলিডোয় ঐরূপ লক্ষণ নেই। নাক্স-ভম-লাইকোর মত সকালে মুখ টক হয়ে থাকে। সকালে বৃদ্ধি। নাক্সের বায়ু নিম্নগামী ও লাইকোর বায়ু ঊর্ধ্বগামী হয়। সালফার -প্রায়ই উদরাময়, বাহ্যে পেলে দাঁড়ান যায় না। বাম কুঁচকিতে বায়ুর চাপ। মার্ক-সল-ডানদিকে শুইতে পারে না। রাত্রে বৃদ্ধি। ঘাম, মুখে লালা জমা ইত্যাদি। সর্বদা মলত্যাগের চেষ্টা। ব্রাইওনিয়া-মল কঠিন। নড়া-চড়ায় কষ্ট। পিপাসা, ঠোঁট শুষ্ক। লিভারে বেদনা, কাশির সঙ্গে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ও নড়লে ব্যথা বাড়ে। ঐ পাশ চেপে শুইলে ভাল থাকে।

পিত্ত-পাথুরী।-ভয়ানক পিত্তশূল, লিভারের স্থানে টাটানি, হাত দেওয়া যায় না। বুক ও গলা জ্বালা করে, মুখে পানি উঠে, কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটফাঁপা।

তুলনীয়।-ক্যাল্কেরিয়া-কার্ব-এটা পাথুরীর যেমন প্রতিষেধক তেমনি এটা সেবনে সত্বরই বেদনা নিবারিত হয়, ক্যাল্কেরিয়া-ধাতুর রোগীর পক্ষেই অধিকতর উপকারী। মেন্থাপিপারেটা- পিত্তপাথুরীর অসহ্য যন্ত্রণা নিবারণে এটার আশ্চৰ্য্য ক্ষমতা লক্ষিত হয়ে থাকে। এমন অবস্থায় ডাঃ হাম্মেন এটার বিশেষ প্রশংসা করে গেছেন। কার্ডয়াস-মেরিয়ানাস এবং চায়না এই দুইটি ঔষধ নিয়মিত সেবন করলে আর নূতন করে পাথুরী জন্মায় না বলে কথিত হয়। চায়না প্রয়োগে যন্ত্রণার শান্তি হয়ে থাকে।

বুক ধড়ফড় করা।-সন্ধ্যাকালে প্রত্যহ বুক ধড়ফড় করে, সেইসঙ্গে পেটফাঁপা থাকে। বায়ুতে পেট উঁচু হয়ে ভরে উঠে। সন্ধ্যায় বিছানায় শুইলে, সিঁড়িতে উঠলে ও খাওয়ার পর বুক ধড়ফড় করে (ক্যাল্কে, পালস, কার্বো-ভেজ, নাক্স-ভম)। বামদিকে শুইলে বৃদ্ধি। ঋতু বন্ধ হয়ে বুক ধড়ফড়ানি।

শোথ।-রোগীর শরীরের নীচের অংশ ফুলে উপরের অংশ, হাত ও বুকের পেশীসকল শুকিয়ে যায়; পেট ফুলা, পা ফুলা ও ক্ষতে পূর্ণ। ঐ সকল ক্ষত হতে অনবরত রস পড়তে থাকলে লাইকো উত্তম ঔষধ। শোথের সাথে পা ফুলা ও পায়ে ঘা হলে লাইকো, রাস ও আর্স উপযোগী। লাইকোর শোথ যকৃৎ আক্রান্ত হলেই বেশী হয়। লিভারের রোগ হতে শোথ দেখা দিলে লাইকো উপযোগী। এক পা গরম, অন্য পা ঠান্ডা। বিকাল ৪টা হতে ৮টা পৰ্য্যন্ত বৃদ্ধি। মদ্যপানের ফলে ও ম্যালেরিয়ার পরও শোথ দেখা দিতে পারে, ফোলা জায়গায় ঘা হয়ে যায়, রস পড়ে, কিন্তু পুঁজ হয় না। প্রস্রাব কম, তাতে লাল তলানি। নিদ্রা হতে উঠে বড় খিটখিটে হয়ে পড়ে। ভাল ঘুম হয় না। চিৎ হয়ে শুইলে আরাম পায় না। এপিসে সর্বাঙ্গের শোথ থাকলেও চোখের নীচের পাতা এবং পা বেশী ফোলে, কিন্তু লাইকোপোডিয়াম যেমন যকৃৎরোগ হতে জাত শোথে অধিকতর উপযোগী, এপিস সেইরূপ কিডনী আক্রান্ত রোগজাত শোথে। এপিস হৃৎরোগজনিত শোথেও ব্যবহৃত হয়, শ্বাসকষ্ট পিপাসাহীনতা, উষ্ণ ঘরে এবং উষ্ণতায় বৃদ্ধি, ঠান্ডায় উপশম।

টাইফয়েড জ্বর।-টাইফয়েডের প্রথম অবস্থায় এই ঔষধ প্রয়োজন হয় না। অনেক ঔষধ দিয়েও যখন ফল হয় নেই রোগীর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে, তখন এই ঔষধ বিবেচনা করা দরকার। বিকার অবস্থা, অজ্ঞানতা, বিড়বিড় করে বকা লক্ষণ দেখা যায়। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষেও যখন দেখা যায় জ্বরের উদ্ভেদ বের হয় নেই, তখন এটা উপকারী। বিছানার কাপড় খোঁটে। সশব্দ বায়ু, বায়ুতে পেট ভরে যায়। কোষ্ঠবদ্ধতা, অঙ্গ মাঝে মাঝে হঠাৎ কাঁপিয়া উঠে। অসাড়ে মূত্রত্যাগ, মূত্রে লালবর্ণের তলানি বা প্রস্রাব বন্ধ থাকে। নিম্ন চোয়াল ঝুলে পড়ে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে নাক ডাকে ও গলায় সর্দি ঘড়ঘড় করে। জিহবা ফুলে মোটা হয়, তাতে ফোস্কা হয়, বের করা যায় না এবং সেটা বের করার চেষ্টা করলে এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকে। হাত-পা ঠান্ডা বা একটি পা ঠান্ডা অন্য পা গরম। ঘুম ভাঙ্গিলে খিটখিটে মেজাজ। শরীরের ঊর্ধ্বাংশ শুকিয়ে যায়, নিম্নাংশ মোটা দেখায় (ক্যালমিয়া), বেলা ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত জ্বর ও অন্যান্য কষ্ট বাড়ে। কপাল কুঞ্চিত, মুখমন্ডল কুঞ্চিত দেখায়।

ম্যালেরিয়া।-সাধারণতঃ বিকাল ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্বর · আসে। শরীরের বাঁ দিকে শীত করে। শীত ও উত্তাপের মধ্যবর্তী সময়ে টক-বমি। খাওয়ার সময় বা পানি পান করার সময় শীত ও কাঁপুনি। শীতের সময় মনে করে বরফের উপর শুয়ে আছে। জ্বর চলে যাবার পর পিপাসা। বার বার পানি খায়, কিন্তু পরিমাণে অল্প (আর্স, চায়না)। মুখ লালবর্ণ। ঘুম পায়। মুখ, গাল, কান, চোখ, আঙ্গুল, হাতের চেটো গরম ও সেই সকল স্থানে জ্বালা। গরম পানি চায়। উত্তাপ অবস্থায় গায়ে ঢাকা রাখে না। শরীরে টকগন্ধযুক্ত ঘাম। জ্বরের সঙ্গে অনেক সময় এক পা গরম ও অন্য পা ঠান্ডা থাকে।

চুল।-অল্প বয়সে চুল পাকে। মাথার চুল উঠে যায়, বিশেষতঃ পেটের রোগের পর, প্রসবের পর। মাথায় টাক পড়ে।

চোখের অসুখ।-রাত কানা, রাত্রে দেখতে পায় না। কোন জিনিষের বামার্দ্ধমাত্র দেখে। অৰ্দ্ধদৃষ্টি। চক্ষের সামনে কাল কাল জিনিষ দেখে। চোখ-প্রদাহে স্রাব গাঢ় হলদে বা সবুজ। পুঁজ, অঞ্জনি বিশেষতঃ ক্যান্থাসের কাছে। চক্ষে রোয়া (granules)।

বাত।-পুরাতন বাত। বৃদ্ধবয়সে বাত। মাংসপেশী ও সন্ধিস্থলে যন্ত্রণা ও আড়ষ্টভাব (rigid)। আক্রান্ত স্থানে অসাড় ভাব। আঙ্গুলের গাঁটে গাঁটে বাত। গোড়ালীর বাত, টেনে ধরার মত ব্যথা, ছিঁড়ে ফেলার মত ব্যথা, বিশেষতঃ রাত্রে। অনেক সময় একদিন অন্তর। বিশ্রামে বাড়ে। বর্ষায় বাড়ে। গরম সেক দিলে কম হয়। ডান কাঁধে বাত। বাঁ জঙ্ঘায় বাত। হার্টে দারুণ যন্ত্রণা, তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে। নড়িতে ভয় পায়। বেলা ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পৰ্য্যন্ত বৃদ্ধি। এক পা ঠান্ডা অন্য পা গরম। কোমরে ব্যথা, নড়াচড়ায় বাড়ে। দুই কাঁধের মধ্যে জ্বালা।

প্রস্রাব। প্রস্রাব ঘন ঘন হয়, তাতে ফেনা। প্রস্রাব সাদা সাদা ও ঘোলা। প্রস্রাবে লাল রঙের তলানি। প্রস্রাবের পূর্বে কোমরে ব্যথা, প্রস্রাবের পর তা থাকে না। শিশুরা প্রস্রাবের পূর্বে কাঁদিয়ে উঠে। বোরাক্সের শিশু প্রতিবার প্রস্রাব করার সময় কাঁদে। প্রস্রাব গরম ও সেটাতে দুর্গন্ধ।

ডিফথিরিয়া। -এই রোগে লাইকো-ল্যাকেসিস, ল্যাক-ক্যানাই ও ফাইটোর মত উত্তম ঔষধ। লাইকোর আক্রমণ প্রথমতঃ ডানদিকে হয়, তারপর সেটা বামদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ল্যাকেসিসে ঠিক এটার বিপরীত অর্থাৎ প্রথমে বামদিক আক্রান্ত হয়ে ডানদিকে প্রসারিত হয়। ঠান্ডা দ্রব্য সেবনে রোগের বৃদ্ধি। ল্যাক-ক্যানাই-এর বেদনা বারংবার পার্শ্ব পরিবর্তন করে, ফাইটোলাক্কায় তীব্র বেদনা, জ্বালা ও শুষ্কতার সাথে রোগী মনে করে তার গলনলী বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে, সে উষ্ণ পানীয় সেবন করতে পারে না। লাইকোর আক্রমণ ডানদিকে আরম্ভ হয় ও বাঁদিকে যায়। অনবরত ঢোক গিলবার ইচ্ছা। তরল পদার্থ বিশেষতঃ ঠান্ডা পানি পানে কষ্ট বাড়ে। বেলা ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত কষ্টের বৃদ্ধি। ঘাড়ের গ্ল্যান্ড ফোলে। নাক আক্রান্ত হয়। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। টন্সিল খুব ফোলে, জিহবা ফোলে। মুখ খুলে রাখে, তবে নিঃশ্বাস নিতে পারে। ল্যাকেসিস দিবার পর লাইকো খুব উপযোগী।

মূত্রগ্রন্থির শূল।-ডানদিকের কিডনি হতে বেদনা আরম্ভ হয়ে সেটা লিঙ্গপ্রদেশে, কখন কখনও পায়ে পর্য্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রস্রাবে লাল ইষ্টকচূর্ণের মত তলানি পড়ে, কোন পাত্রে প্রস্রাব ধরলে লালবর্ণের তলানি পড়ে। মূত্র-গ্রন্থিশূল রোগে লাইকো, বার্বেরিস ও ক্যান্থারিস এই কয়টি ঔষধই উত্তম। মূত্রশূলের অত্যধিক যন্ত্রণা হ্রাস করতে বার্বেরিস উপযোগী ঔষধ (ক্যান্থারিস)।

ক্ষয়কাশি।-যদি অন্ত্রের কোনরূপ বিশৃঙ্খলা ও মলরোধাদির জন্য ক্ষয়কাশি হয় তবে এই ঔষধ দ্বারা উপকার হবে। ফুসফুস-প্রদাহ (নিউমোনিয়া) বা বায়ুনলীভূজ-প্রদাহ (ব্রঙ্কাইটিস)-এর পরবর্ত্তী ফলস্বরূপ যখন ক্রমে রোগীর যক্ষ্মারোগ হয়, তখন (প্রথমাবস্থায়) এই ঔষধ ফলপ্রদ। ডাঃ হিউজেস বলেন, যে সকল যুবকদের যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় তাদিগকে এই ঔষধ দিলে উপকার হয়; গয়ারে লবণাক্ত স্বাদ, গন্ধকের ধোঁয়া গলায় প্রবেশ করলে যেরূপ শুষ্ক কাশি হয়, সেইরূপ শুষ্ক কাশি, গয়ারে রক্তের ছিট থাকলে লাইকো ব্যবহার্য্য। ডাঃ ন্যাশ বলেন, যে সমস্ত নিউমোনিয়া রোগী কুচিকিৎসিত হয় বা উপেক্ষিত হয় তাদের যক্ষ্মারোগে পেট ফাঁপা থাকলেও রোগের আক্রমণ বৈকাল ৪টা হতে রাত্রি ৮টায় হলে এটাই ঔষধ।

ক্রিমিরোগ।-ডাঃ টেষ্টি বলেন যে, লাইকো ৩০, দুই দিন; ভেরেট্রাম-ভি ১২, চারদিন এবং ইপিকাক ৬, সাত দিন ক্রমান্বয়ে সেবন করলে ক্রিমি রোগে বিশেষ উপকার দর্শে।

জননেন্দ্রিয়ের রোগ। -যুবকগণ অতিরিক্ত হস্তমৈথুনাদি করে যখন ক্লীবত্বে পৌঁছায় অর্থাৎ যখন তাদের ধ্বজভঙ্গ হয় তখন লাইকো উপযোগী; অস্বাভাবিক উপায়ে যারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে ধ্বজভঙ্গ রোগের সৃষ্টি করে, যাদের জননেন্দ্রিয় ক্ষুদ্র, শিথিল ও ঠান্ডা হয় তাদের পক্ষে এটা ব্যবহার্য্য। বৃদ্ধদের ধ্বজভঙ্গ রোগে যখন তাদের কামপ্রবৃত্তি অত্যধিক, কিন্তু লিঙ্গোত্থান মোটেই হয় না, তখন এটা উপযোগী ঔষধ। তুলনীয়। ক্যালেডিয়াম -সঙ্গমের ইচ্ছা প্রবল হলেও সঙ্গমের ক্ষমতা লুপ্ত। সঙ্গমের সময়ে লিঙ্গ শিথিল ইহয়া যায় এবং সেটার উত্থানই হয় না। কোনায়াম-সঙ্গমেচ্ছা প্রবল অথচ ক্ষমতা নেই। স্ত্রীলোক দেখিলে, আলিঙ্গন করলে অথবা চিন্তা করলেও, অসাড়ে বীর্য্যপাত হয়। ফস্ফোরাস -কামেচ্ছা বেশী, কিন্তু লিঙ্গোত্থান ভালভাবে হয় না। ধ্বজভঙ্গ।

রজঃরোধ। -যদি ভয় পেয়ে বৎসরাধিত কাল রজঃ বন্ধ থাকে অথবা কোনরূপ মানসিক উচ্ছ্বাস হেতু ঋতুরোধ হয় তবে লাইকো অ্যাকোনাইটের তুল্য ঔষধ। অ্যাকোনের বিশেষ লক্ষণ স্মরণ রাখা কর্তব্য। লাইকো রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য, অজীর্ণ ও অম্লভাবের সাথে লাইকোর অপরাপর লক্ষণ বিদ্যমান থাকলে এটাই ঔষধ।

প্রদর স্রাব। -হঠাৎ অনিয়মিত সাদা স্রাব জন্য জননেন্দ্রিয় অত্যন্ত জ্বালা করে। পূর্ণিমার সময় অত্যন্ত বেশী হয়, স্রাব ত্বকক্ষয়কারক, যেখানে লাগে হেজে যায়। লাইকোতে রক্ত-প্রদরও আছে। রোগিণীর প্রত্যেকবার মলত্যাগের পর (সেটা কঠিন হোক কি তরলই হোক) রক্তস্রাব হবেই। লাইকো রোগিণীর যোনির অভ্যন্তর অত্যন্ত শুষ্ক, সঙ্গম করার সময় অত্যন্ত কষ্ট পায় এবং সঙ্গমের পর ভিতরে জ্বালা করে। তার কামোন্মত্ততা অত্যধিক, সেই সঙ্গে যোনির অত্যন্ত চুলকানি। ওভারির প্রদাহ বা ওভারির বিকৃতি, ডিম্বাধারের অর্বুদ, শোথ, প্রথমতঃ ডানদিকের ওভারি আক্রান্ত হয়, তৎপর রোগ বামদিকে চালিত হয়।

হৃৎপিন্ডের রোগ। -যদি পরিপাক ক্রিয়ার বিকৃতি জন্য, পরিপাক ক্রিয়ার সময় কিংবা সন্ধ্যার পর শায়িতাবস্থায় হৃত্যন্ত্রের স্পন্দন হয়, রোগীর নাড়ী দ্রুত, মুখমন্ডল ও পা শীতল হয়, তবে লাইকো উত্তম ঔষধ। হৃত্যন্ত্রের রোগের সাথে রোগীর নাকের পাখাদ্বয় উঠানামা করে। হৃৎরোগীর শ্বাসস্বল্পতা, সর্বাঙ্গ নীল হয়ে যাওয়া ও ত্বরান্বিত পানাহার লাইকোর লক্ষণ।

হার্ণিয়া বা অন্ত্রবৃদ্ধি। যখন ডানদিক আক্রান্ত হয় তখন এটা ফলপ্রদ। ডাঃ ন্যাশ বলেন, ডানদিকের হার্ণিয়া রোগে ট্রাস ব্যবহার প্রয়োজন হয় না, লাইকো দ্বারাই আরোগ্য হয়। বামদিকের হার্ণিয়ায় নাক্স ভমিকা ফলপ্রদ। বামদিকের হার্ণিয়ায় ল্যাকেসিসও উপযোগী।

ক্রোফিউলাস বা গন্ডমালা ধাতের শিশু। এ ক্ষেত্রে ক্যাল্কেরিয়া ও সাইলিসিয়া যেমন ঔষধ, সেইরূপ লাইকোপোডিয়ামও ফলপ্রদ ঔষধ। লাইকোপোডিয়াম শিশুর কথা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

নিদ্রা।– রোগীর দিনের বেলায়ই বেশী নিদ্রা হয়, রাত্রে অনিদ্রা; রাত্রে ঘুম ভাঙ্গিবার পর নানারূপ চিন্তার উদয় হয়। ঘুমের ভিতর সে কিছুতেই শান্তি পায় না, ঘুমাতে ঘুমাতে কাঁদিয়ে উঠে। (ক্যামো, হায়ো), চমকিয়ে উঠে, নানাবিধ দুঃস্বপ্ন দর্শন করে, বার বার তার ঘুম ভেঙে যায় এবং রাত্রি ৪টায় সে সম্পূর্ণ জাগ্রত হয়, আর তাঁর ঘুম হয় না। নাক্স রোগীর রাত্রি ৩টা ৪টার সময় ঘুম ভেঙে যায় তখন নানাবিধ চিন্তা করে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ে-সেই ঘুম অনেক বেলায় ভাঙ্গে। লাইকোর শিশুর ঘুম ভেঙে গেলে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত ভাব প্রকাশ পায়, পা ছুঁড়িতে থাকে ও অত্যন্ত ক্ষুধা পায়।

শেষ কথা।-লাইকো হ্যানিমানের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্ত্তিস্তম্ভ। শক্তিকৃত ঔষধের ক্রিয়া সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করেন, তাঁহারা লাইকোর ক্রিয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। লাইকো ১২ শক্তির নিম্নে বিশেষ কোন উপকারেই আসে না। কিন্তু উচ্চ শক্তিতে এটার ক্রিয়া অপূর্ব ও অমোঘ। লাইকো ধীরগতিশীল ঔষধ, সুতরাং এটার রোগও ধীরে ধীরে বাড়ে। উপশমও ধীরে ধীরে হয়। লাইকোর রোগী মাত্রেরই উদরযন্ত্রের বিশৃঙ্খলা লক্ষণ থাকে। কোষ্ঠবদ্ধ, উদরে বায়ুসঞ্চয়, পেটে ভুট-ভাট শব্দ প্রভৃতি উদর লক্ষণ না থাকলে সেটার উপযোগিতা নেই। আবার উদর-লক্ষণটি সুস্পষ্ট থাকলে সেটা নাম জানা অথবা না জানা যে কোন রোগে উপযোগী হয়। দ্বিতীয়তঃ বৈকাল ৪টা হতে ৮টায় বৃদ্ধি লক্ষণটিও অতি মূল্যবান। মাত্র এই লক্ষণটি অবলম্বনেও শত শত রোগী লাইকো দ্বারা আরোগ্য হয়েছে। লাইকো ল্যাকেসিসের পরিপূরক ঔষধ।

তুলনীয়। লাইকো বৈকালে তাপ বৃদ্ধিতে সাঙ্কার; মুখে ও কপালে পিত্ত চিহ্নে-খুজা; রাক্ষুসে ক্ষুধায় চায়না, সোরি, আয়োড; নাসাপুটের আকুঞ্চন ও প্রসারণে অ্যান্টি-টার্ট, চেলিডো, ফস, কেলি-ব্রোম; একাকী থাকতে ভয় লক্ষণে — কেলি-কার্ব, আর্জ-নাই; অন্ধকারে ভীতি লক্ষণে- ক্যাঙ্কে, ট্র্যামো; পর্যায়ক্রমে হাসা ও কাঁদা লক্ষণে পালস, অরাম, ইগ্নে, সিপি; মূৰ্চ্ছাবায়ুতে – ইগ্নে, পালস; গলক্ষতে-ল্যাকে; হার্ণিয়া রোগে-নাক্স-ভম; পা ঠান্ডায়-ক্যাঙ্কে; প্রসাব করার পূর্বে শিশু ক্রন্দন করায়-সার্সা; বিপত্নীকদের রিপুচরিতার্থ না হওয়ার জন্য রোগে-কোনা, অ্যাসিড-পিক, ক্যাঙ্কে; সঙ্গমকালে অপত্যপথে জ্বালা লক্ষণে-ক্রিয়ো, সাফ; অম্লত্ব ও অজীর্ণতায়- ম্যাগ-কার্ব, রোবিনিয়া; নিউমোনিয়ায় কুচিকিৎসার ফলে -কার্বো-ভেজ; চায়না; আহারান্তে পেট ভার লক্ষণে- চায়না তুল্য। তাছাড়া লাইকো পেঁয়াজ, রুটি, সুরাদি মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তাম্রকূট চর্বণের দোষ নষ্ট করে।

বৃদ্ধি।– বিকাল ৪টা হতে ৮টা পর্যন্ত; খাওয়ার পর; মাথায় কাপড় জড়ালে; টুপী পরিলে; মাসিক ঋতুর পূর্বে; ঋতু বন্ধ থাকলে; শুইলে; শয্যা হতে উঠলে; গ্যাসের আলোকে; কোন জিনিসের প্রতি একদৃষ্টে চাইলে; কফি খেলে; ঠান্ডা খাদ্যে; খোসা শুদ্ধ তরকারী খেলে; মদ্যপানে; আসন হতে উঠলে; উগ্র গন্ধে; প্রস্রাব করার সময়; খোলা বাতাসে; শরীর গরম হলে; ঝড়ের সময়; গায়ে ঢাকা দিলে।

হ্রাস। শরীর ঠান্ডা হলে; অনেক লোকের মধ্যে; ঢেঁকুর উঠলে; বায়ু নিঃসরণে; মাথার আবরণ খুললে; কাপড় ঢিলা করলে; নড়াচড়ায়; আসন হতে উঠলে; শরীর অনাবৃত করলে; গরম বা উষ্ণ খাদ্যে; বিছানায় শরীর গরম হলে।

শক্তি।-৬, ৩০, ২০০, ১০০০ বা তদূর্দ্ধ শক্তি ।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!