চেলিডোনিয়াম–মেজাস (Chelidonium Majus )
পরিচয়। এটার অন্য নাম গ্রেটার-সিলেন্ডাইন।
ব্যবহারস্থল।-যকৃতের বিভিন্ন রোগ, ন্যাবা প্রভৃতি। ডাঃ অ্যালেন বলেন-ফ্যাকাসে পাতলা ও রাগী ব্যক্তিদের যকৃৎ ও পাকাশয়ের রোগে এটা একটি মূল্যবান ঔষধ। যকৃতের বিবৃদ্ধি, কাঠিন্য ও তাতে সূচীবিদ্ধবৎ বেদনা, ডানদিকের স্কন্ধদেশের নিম্নে অনবরত বেদনা (বাম স্কন্ধফলকের নিম্নে বেদনা-চিনোপোডিয়াম-গ্নকাই) এটার বিশেষ লক্ষণ। ব্রঙ্কাইটিস, হুপিংকাশি, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া-জ্বর, স্বল্পবিরাম জ্বর, স্নায়ুশূল, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির বেদনা, কোষ্ঠকাঠিন্য চোখের স্নায়ুশূল, উদরাময় প্রভৃতি।
প্রদর্শক লক্ষণ।– ডানদিকের স্কন্ধাস্থির নীচে নিশ্চল বেদনা। আলস্য, চলাফেরার প্রবৃত্তি থাকে না। মাথার পিছনদিক বরফের মত ঠান্ডা, ভারী বোধ। মাথাঘোরা। ডান চোখের উপর নিউরালজিক বেদনা, চোখ হতে প্রচুর পানি পড়ে। নাকের পাতা পাখার মত নড়ে। চোখ, মুখ, হাত, পা সর্বশরীর হলুদবর্ণ, জিহবা হলদে, বড় ও তাতে দাঁতের দাগ। অত্যন্ত গরম খাদ্য ও পানীয় পছন্দ করে। বমি, গা-বমি-বমি, খুব গরম পানি খেলে কম হয়। শূলবেদনা, খেলে কমে। প্রস্রাব হলদে, তাতে ফেনা। মল হলদে বা সাদা। শক্ত, গোল ডেলা। মল পানিতে ভাসে। বেদনার সময় পা দুইটি গুটাইয়া শোয়। আঙ্গুলের ডগ বরফের মত ঠান্ডা। বিকালে স্বরভঙ্গ। কাশিতে শ্লেষ্মার ডেলা লাফাইয়া পড়ে (ব্যাডিয়েগা)। ডানদিকের নিউমোনিয়া। সর্দি প্রচুর। বিকালে পাঁচটার সময় স্বরভঙ্গ। লিভার লক্ষণ। রোগ ডানদিকে বেশী। ঋতু পরিবর্তনের সময় রোগ।
মন। -রোগীর ক্রন্দনশীলতা ও বিমর্ষভাব খুব বেশী, কিন্তু সে এটার কারণ নিজেই জানে না। বড়ই অন্যমনস্ক। একটু আগে কি করেছে তাও বলতে পারে না।
শিরোরোগ।-অত্যন্ত মাথা ঘুরে, ঐ সঙ্গে পিত্ত-বমন ও যকৃৎ মধ্যে বেদনা। মাথা ঘোরার জন্য সামনের দিকে টলে পড়বার উপক্রম হয়। ডান চোখের উপরে বেদনা, চোখ হতে পানি পড়ে। চোখ বুজে শুয়ে থাকলে উপশম বোধ করে। মাথার পশ্চাৎ দিকটা এত ভারী যে রাত্রিকালে বালিশ হতে মাথা তুলতে পারে না। যকৃতের রোগের জন্য মাথায় যন্ত্রণা, ঘাড় হতে মাথার পিছন পর্যন্ত বরফের মত ঠান্ডা। বিশ্রামের পর বা কিছু খাওয়ার পর উপশম। মাথার চামড়ার উপর পিপীলিকা চলে বেড়াচ্ছে বোধ।
যকৃতের রোগ ও ন্যাবারোগ। – চেলিডোনিয়ামের রোগীর যকৃতে বেদনা, স্পৰ্শদ্বেষ ডানদিকের স্কন্ধে বেদনা, উজ্জ্বল সোনালী রঙের মল বা ছাগলের নাদির মত মল। ন্যাবারোগে মল ছাইবর্ণ বা গন্ধকের বর্ণ। কাপড়ে সেটার দাগ লাগে। রোগীর মনটি বড়ই বিষণ্ন। জিহবা মোটা হলুদাভ ক্লেদযুক্ত ও সেটাতে দন্তছাপ থাকে। অত্যন্ত গরম খাদ্য ও পানীয় চায়। ডাঃ গ্যারেন্সি বলেন- ডানদিকের স্কন্ধাস্থির নিম্ন কোণে বেদনা এবং বক্ষঃস্থল, পেট ও কুদি পর্য্যন্ত সেই বেদনা বিস্তৃত হওয়া এটার নির্দিষ্ট লক্ষণ। যকৃতের দোষযুক্ত যে কোন রোগে এই লক্ষণ থাকলে এই ঔষধ কাজ করে।
তুলনীয়।– চেনোপোডিয়াম – এতে ডান কাঁধের নীচে বেদনা হয় এবং ব্যথা মেরুদন্ড পর্য্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। নাক্স ভমিকা-ডান কাঁধের নিচে বেদনা আছে, তবে বার বার মলবে এটার পরিচায়ক লক্ষণ। ব্রাইয়োনিয়া- তীব্র সূঁচফোটান বেদনা, ডান কাঁধে বেদনা, মুখে তিক্তাস্বাদ, কিন্তু কোষ্ঠবদ্ধতার স্বভাব। চিয়োন্যান্থাস যকৃতের রোগের সাথে কোষ্ঠবদ্ধতা ও রক্তশূন্যতা, পাক- যন্ত্রের ভিতর সেঁটে ধরা ভাব। কার্ডয়াস মেরিয়েনাস – যকৃতের রোগের সাথে ন্যাবা ও যকৃতে রক্তসঞ্চয়। লাইকোপোডিয়াম-রোগী অত্যন্ত গরম দ্রব্য চায়। লাইকোর বিশিষ্ট লক্ষণ বৈকাল ৪টা হতে রাত্রি ৮টা পর্য্যন্ত রোগের বৃদ্ধি। রোগীর পেটে বায়ু জমে, পেটে ও যকৃতে মৃদুমন্দ বেদনা। জুল্যান্স-সিনেরিয়া যকৃতের চারিদিকে টাটানি ব্যথা ও ডানদিকের কাঁধের নীচে বেদনা থাকে, সেইসঙ্গে ঢেঁকুর উঠা, পেটফাঁপা, সবুজ বা হলদে বর্ণের বাহ্যে।
নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হুপিং–কাশি ইত্যাদি। -ডাঃ টেষ্টি বলেন-শ্বাসযন্ত্রের রোগে চেলিডোনিয়াম বিশেষ কাজ করে। হুপিং-কাশি এবং ফুসফুসের প্রদাহেও এটা ভাল কাজ করে। হুপিং-কাশিতে কোরালিয়াম-ব্রামের পর এই ঔষধে বিশেষ উপকার দর্শে। হুপিং-কাশিতে ভোগার পর যদি হাম বের হয় এবং তার পর যদি নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিস হয়, সে ক্ষেত্রে চেলিডোনিয়াম বিশেষ কাজ করে। ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ায় রোগী অনবরত হাই তোলে ও গা ভাঙ্গে, দেখিলে মনে হয় যেন কত রাত্রি সে বিন্দ্রি ভাবে কাটাইতেছে। নিউমোনিয়া বা হুপিংকাশির সাথে সাধারণতঃ শিশুর যকৃতের দোষ দেখা যায়। অনবরত ঘড়ঘড় শব্দবিশিষ্ট কাশি, গয়ার খুব সহজেই নিঃসৃত হয়ে থাকে, শ্বাসস্বল্পতj ও ডান-স্কন্ধাস্থির নিম্নে তীক্ষ্ণ বেদনা থাকলে চেলিডোনিয়ামই একমাত্র ঔষধ। নিউমোনিয়ায় রোগী অতি দ্রুত অথচ অতি সন্তর্পণে নিঃশ্বাস গ্রহণ করে। দীর্ঘ-নিঃশ্বাস টানিলে বক্ষের ডানাকে সূচফোঁটান ব্যথা অনুভূত হয়। ডাঃ লডলাম বলেন- বালক-বালিকাদের সর্দিযুক্ত নিউমোনিয়া রোগে অত্যন্ত ঘড়ঘড়ানি থাকা সত্ত্বেও যখন রোগী কিছুতেই গয়ার তুলে ফেলতে পারে না, তখন এটা বিশেষ ফলপ্রদ। হামের সাথে নিউমোনিয়া থাকলে এটা অতি উচ্চাঙ্গের ঔষধ। নিউমোনিয়ার কোন অবস্থায় ডান স্কন্ধাস্থির নিম্নে বেদনা, মুখে আরক্ততা, নাকের পাখা উঠা- নামা করা। অতি উষ্ণ দুধ পানীয়ে ইচ্ছা, জিহবা হলদে, দন্ত ছাপযুক্ত ও যকৃত-লক্ষণ চেলিডোনিয়াম- জ্ঞাপক (অনুপূরক-মার্ক-সল)।
তুলনীয়।-লাইকোপোডিয়াম– চেলিডোনিয়ামের মত লাইকোপোডিয়ামেও ডান ফুসফুস আক্রান্ত হয়। অচিকিৎসিত এবং কুচিকিৎসিত অবস্থায় অধিকতর উপযোগী। অপরাহ্ন ৪টা হতে রাত্রি ৮টার মধ্যে বৃদ্ধি। ব্রাইয়োনিয়া ডানদিক অধিক আক্রান্ত হয়। বুকে সূঁচফোটান ব্যথা, ব্যথার জন্য কাশবার সময় রোগী হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে। পিপাসার জন্য রোগী খুব দেরিতে দেরিতে অধিক পরিমাণে পানি পান করে।
স্নায়ুশূল।-ডান দিকের স্নায়ুশূলেই এটা বেশী ব্যবহৃত হয়। মুখমন্ডলের স্নায়ুশূল উদরশূল, কিছু খেলে কমে, সঙ্গে কোষ্ঠবদ্ধ (গ্রাফাইটিস, অ্যানাকার্ডিয়াম)।
ম্যালেরিয়া-জ্বর।-চেলিডোনিয়ামের জ্বরের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। এতে কখনও শীত করে কখনও বা শীত না করে জ্বর হয়, তবে এটার উত্তাপ সাধারণতঃ মুখেই বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। জ্বরের সাথে যকৃতে এবং ডান পৃষ্ঠফলকাস্থির নীচে বেদনা, প্রচুর ঘর্ম্ম হওয়ার পর ঐ বেদনার উপশম। জিহবায় হরিদ্রাবর্ণের লেপ, দত্তছাপ অথচ জিহবার ধারগুলি লাল। মুখের স্বাদ তিক্ত, জ্বরের সময় উষ্ণ দুধপান করার প্রবল ইচ্ছা হয় এবং পান করলে হজমও হয় (কার্বো-ভেজ দুধ পান করলে পেট ফাঁপে), খালি পেটে থাকলে পেটে ব্যথা হয় এবং কিছু খাওয়ার পরই সেটা কমে যায় (অ্যানাকার্ডিয়াম, পেট্রোলিয়াম)। চেলিডোনিয়ামের পর আর্সেনিক প্রায়ই কাজে আসে।
স্তনদুধের বিলোপ। যকৃত-লক্ষণ সহ সুন্দরী নারীদের স্তনদুধের বিলোপ (এসাফিটিডা, এগ্লাস- ক্যাষ্টাস, ক্যাক্টাস-গ্র্যাণ্ডি) ও গর্ভাবস্থায় বমনরোগে চেলিডোনিয়াম ব্যবহৃত হতে পারে।
সম্বন্ধ।– ফুসফুস প্রদাহে-মার্কারি। প্রদর রোগে কেলি-কার্ব, কার্বো-অ্যানি অনুপূরক। যকৃৎ রোগে-ব্রাইয়োনিয়ার অপব্যবহারে চেলিডোনিয়াম ফলপ্রদ। চেলিডোনিয়াম প্রয়োগে লক্ষণাদি বৃদ্ধি পেলে অ্যাকোনাইট। বাতরোগে লেডামের পর চেলিডোনিয়াম, জ্বরে চেলিডোনিয়ামের পর আর্সেনিক। চেলিডোনিয়াম প্রয়োগে রোগ কতক উপশম হওয়ার পর লাইকোপোডিয়াম ও সাম্ফারে উপকার দর্শে।
বৃদ্ধি।– ডান দিকে; অতি প্রত্যুষে; নড়া-চড়ায়; স্পর্শে; ঋতু পরিবর্তনে।
হ্রাস।-খাওয়ার পর; চাপ দিলে; গরম পানি পান করলে।
শক্তি।-মূল-অরিষ্ট, ১x, ৩, ১২, ৩০, ২০০ ব্যবহার্য্য।