এপিস্–মেলিফিকা (Apis Mellifica)
পরিচয়।— জীবিত মধুমক্ষিকার হুল হতে প্রস্তুত হয়।
ব্যবহারস্থল। শোথ উদরী, ফোঁড়া, কার্বাঙ্কল, বিসর্প, পচা-নালীক্ষত, গ্রীষ্মকালীন ব্রণ, অর্বুদ, হাঁপানি, উপদংশ, উদরাময়, শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য, চোখের অসুখ, হৃদযন্ত্রের রোগ, মেনিঞ্জাইটিস, আঙ্গুল-হাড়া, আমবাত, গলক্ষত, জিহবার স্ফীতি, টাইফয়েড জ্বর, মূত্র-বিকার, গো-বীজে টিকার মন্দ ফল, হাম, বসন্ত, গুরিসি, বাত ইত্যাদি।
ক্রিয়াস্থল।–এপিসের ক্রিয়া বিধান-তন্তুসমূহের উপর। উপত্বক ও রক্তাম্বুস্রাবী ঝিল্লীতে বিশেষভাবে কাজ করে। এটার প্রদাহ সবল প্রকৃতির নয়। সেটাতে ক্রমশঃ বিধান-তন্তুসমূহ নষ্ট করে। এইজন্য এপিসজ্ঞাপক পুরাতন রোগীমাত্রেই রক্তহীন, ফ্যাকাসে এবং প্রায়ই কোন না কোন অঙ্গে শোথগ্রস্ত হয়।
প্রদর্শক লক্ষণ।— মৌমাছি হুল ফুটাইলে যেরূপ ব্যথা করে সেইরূপ ব্যথা ও সেই সাথে জ্বালা। পিপাসার অভাব কদাচিৎ দারুণ পিপাসা, বার বার পানি পান করে, কিন্তু পরিমাণে খুব কম পানি খায় (আর্স)। প্রস্রাব পরিমাণে খুবই কম। উজ্জ্বল বর্ণবিশিষ্ট। প্রচুর প্রস্রাব (কদাচিৎ)। প্রস্রাব কখন রক্তময়; কখন দুধের মত। আবার ঘোলা বা কালচে (dark) ও ফেনা ফেনা। প্রস্রাবে খুব দুর্গন্ধ। প্রস্রাব করার আগে, প্রস্রাব বের হওয়ার সময় এবং প্রস্রাব হয়ে যাবার পর মূত্রনলীতে জ্বালা করে। মূত্রথলীতে (bladder) অস্বস্তিকর ভাব, যন্ত্রণা, ঘন ঘন প্রস্রাব করার ইচ্ছা। প্রস্রাব ধারণে অক্ষমতা, আপনা আপনি প্রস্রাব হয়ে যায়, বিশেষতঃ রাত্রে ও কাশবার সময়। মস্তিষ্ক বিকারে হতে হতে রোগী হঠাৎ চীৎকার করে উঠে। সহজেই চোখে পানি আসে, না কাঁদিয়ে থাকতে পারে না। একলা থাকতে চায় না। খিট্খিটে মেজাজ, কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। পড়বার সময় পড়ায় মন লাগাতে পারে না। তড়কা, খোলা বাতাসে আসলেই উপশমিত হয়। চোখ বুজলে বা চোখের সামনে পর্দা বা অন্য কিছু ধরলে মাথা ঘোরে। কৃত্রিম আলোকে পড়তে পারে না, তাতে চোখে যন্ত্রণা হয়। মুখের ডানদিকে পক্ষাঘাত ও সেইসঙ্গে ডান চোখ মুদ্রিত থাকে, খুলতে পারে না। শরীরের নানাস্থানে ফুলা। চোখের পাতাগুলি, বিশেষতঃ চোখের নীচের পাতা ফুলা। ফুলার সঙ্গে পিপাসা থাকে না। আক্রান্ত স্থানের রঙ মোমের মত সাদা। চোখের রোগ, ঠান্ডায় উপশম; গরমে বৃদ্ধি। সমস্ত যন্ত্রণা ঠান্ডায় উপশম হয়। রোগ ডানদিকে আরম্ভ হয়ে বাঁদিকে যায়, যথা—ইরিসিপেলাস (মুখ)। জিহবা বের করতে পারে না। এটা কাঁপে ও দাঁতে ঠেকে। নাকের ডগা ঠান্ডা। দুধ খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা (রাসটক্স)। সকাল ও সন্ধ্যায় গলার মধ্যে চট্ট্চটে শ্লেষ্মা জমে, তা বের করতে বেগ পেতে হয়। টনসিল বড়, সেগুলি খুব লাল। গলায় হুলফোটান ব্যথা। টন্সিল পাকে। টনসিলে গৰ্ত্ত গৰ্ত্ত ঘা। পিপাসা নেই। প্রস্রাব অল্প। চটচটে ফেনা ফেনা বা সফেন লালাস্রাব। উদরাময়ের সাথে জিহবার রঙ সাদা হয়ে যায়। উদররোগে ও উদরভঙ্গে পেটে টাটানি, চুঁইলেই চমকে উঠে।—শীতকালে হাঁপানি রোগ। শোয়ার পর ও ঘুমাবার পর কাশি। পাগুলি ঠান্ডা ও পায়ে অসাড় ভাব। কার্বাঙ্কল। জ্বালা। হুলফোটান ব্যথা। গোলাপী রং। গরমে কষ্ট বাড়ে; ঠান্ডা দিলে কষ্ট কম হয়। স্পর্শকাতরতা। ইরিসিপেলাস। ফোলা জাতীয়, ফোস্কাকার নয়। গোলাপী রং। চড়চড় করে। অপরাহ্নে বৃদ্ধি। জ্বালা। ডান কুঁচকিতে পটলের মত বড় ফুলা। ওভেরীতে সর্বদাই ভারীবোধ। টাটান, হাত দেওয়া যায় না। ডানদিকে শুইলে কষ্ট কম হয়। ওভেরীতে টিউমার, হুলফোটান ব্যথা। ওভেরির রোগের সঙ্গে স্তনের বোঁটা উল্টাইয়া থাকে। আঙ্গুলহাড়ার প্রথম অবস্থা, সেই সাথে জ্বালা, হুলফোটান ব্যথা। রোগী ভিতরে অস্থির, কিন্তু বাহ্যিক তার প্রকাশ কম। অপরাহ্ন ৩টার সময় জ্বর। গায়ের ঢাকা খুলে ফেলে। ঘামের পর আমবাত। পিপাসার অভাব। ঠান্ডা চায়। গরমে কষ্ট। গাত্রত্বক স্পর্শকাতর। এমন কি চুলটি পর্য্যন্ত নাড়বার উপায় নেই। ইরাপটিভ রোগে উদরাময়, বিশেষতঃ ইরাপসন্ বসে যাবার পর ডাইরিয়া হলে (অ্যান্টিম-টার্ট, সালফার)। ঠান্ডা পানিতে ধুইলে সকল কষ্টই কম হয়। গায়ে ঠান্ডা জিনিস, ভিজা গামছা প্রভৃতি চায়। হাঁপানি রোগ। শীতকালেই বেশী হয়। গলার কাছে কাপড়-জামা কিছুই রাখতে পারে না। ঔষধ প্রয়োগের পর প্রস্রাব বৃদ্ধি শুভ লক্ষণ।
মন।—রোগী কখনও অসম্ভব ছ্যাবলা, কখনও সম্পূর্ণ উদাসীন। স্বভাবতঃ হিংসুটে ও দ্বেষপ্রবণ। কখন কখনও মৃত্যুর কথা বলে, কিন্তু ভয় হয় না। ছোট ছেলে বড়ই অস্থির, ছটফটে ও ক্রন্দনশীল। ফিজিডিটি, হাত হতে জিনিসপত্র পড়ে যায়, সেজন্য লজ্জিত হয় না (বোভিষ্টা, অ্যাগারিকাস)। তরুণরোগে মস্তিষ্ক শ্রান্ত হয়ে পড়ে। স্নায়বিক কম্পন দেখা যায় কিন্তু মুখকান্তি মলিন দেখায় না।
শোথ। —বেরিবেরি রোগে বা অন্য কোনও রোগের পর বা রোগের শেষের দিকে যদি শোথ অথবা ফুলা দেখা দেয় তবে এপিসের প্রয়োজন হয়। সেলুলার-টিসুর ফুলা, আঙ্গুলের টিপ দিলে বসে যায়। গাত্রত্বক মোমের বর্ণ, চর্ম স্বচ্ছ ও পিপাসাহীনতা। চোখের নীচের পাতা দুইটি থলির মত জলপূর্ণ দেখায়। শোথরোগ, প্রস্রাব বন্ধ বা অল্প প্রস্রাব এবং জ্বালা বিদ্যমান থাকে। ঠান্ডায় ঐ জ্বালা কম পড়ে।
সদৃশ ঔষধ। -কেলি-কার্ব—শোথে চোখের উপরের পাতা (এপিসে নীচের পাতা ফুলা) ফুলে থলির মত হয়। কেলি-কার্বের রোগীর হৃদপ্রদেশে সূঁচফোটান ব্যথা থাকে। ফস্ফোরাস– এটার রোগীর সমস্ত মুখই ফুলে, কিন্তু এটার পিপাসা খুব প্রবল, আর এগিসের পিপাসা মোটেই নেই। অ্যাপোসাইনাম-অত্যধিক পিপাসা থাকে, কিন্তু পাকস্থলীর উত্তেজনাহেতু পানি পান করিবামাত্র বমি হয়ে যায়। অ্যাসিড-অ্যাসেটিক এটার শোথের রোগীর গায়ের চামড়া, বিশেষতঃ হাতের ও পায়ের চর্ম মোমের মত ফ্যাকাসে। শোথ রোগে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব, প্রবল পিপাসা, উদরাময় ও বমন এটার প্রধান লক্ষণ। আর্সেনিক এটার রোগীর শোথ সর্বাঙ্গব্যাপী। এতে অস্থিরতা ও শয্যাশায়ী অবস্থা দুইটিই বেশ পরিস্ফুট। বোগীর অদমনীয় পিপাসা থাকে, কিন্তু পানি সহ্য হয় না। আর্সেনিকের গরম গরম ঢাকা, আর এপিনের রোগী ঠান্ডা চায় (আর্সেনিক ও অ্যাপোসাইনাম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
চোখের অসুখ।—রোগের আশে-পাশে গোলাপী রং, চক্ষুরোগে নীচের পাতা ফুলে যায়, চোখের ভিতরে ও বাহিরে প্রদাহ, অত্যন্ত জ্বারা ও হুলফোটান ব্যথা, বেলা ৩টায় যাতনার বৃদ্ধি। ঠান্ডায় উপশম। রাস-টক্স –অত্যধিক অস্থিরতা দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পরই চোখে পুঁজ জন্মে। আর্সেনিক —এটার মানসিক উদ্বেগ, অস্থিরতা প্রভৃতি রাত্রি ও দিবা দ্বিতীয় প্রহরের পর বৃদ্ধি, পূজ জন্মিবার প্রবণতা।
স্ত্রীরোগ। স্ত্রীলোকদের মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালিত হয়। ও জরায়ু প্রদেশে প্রসব বেদনার মত বেগ ও বেদনা থাকে, ঋতু প্রকাশিত হয় না।
ডিম্বকোষ ও জরায়ুর প্রদাহ, গুল্মরোগ। ডানদিকের ডিম্বকোষই বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকে, সেখানে হুলফোটানবৎ ব্যথা হয়, সেইসঙ্গে অত্যধিক কামেচ্ছা বিদ্যমান থাকে। সাধারণতঃ বিধবাদের রোগেই বেশী কাজে আসে।
প্রদর রোগেও এটা কার্যকরী, এটার প্রদর অত্যধিক পরিমাণে হয়, সেটা রুক্ষ এবং হলুদাভ। ঋতুবন্ধ হয়ে শোথ, অতিশয় উত্তেজনাসহ কাম প্রবৃত্তির প্রাবল্য।
গর্ভস্রাব। হেরিং বলেন—গর্ভাবস্থায় এপিস নিম্নতর শক্তিতে প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য নয়, কারণ নিম্নশক্তির এপিস অনেক সময় গর্ভপাত করিয়ে দেয়। এপিস ৬ষ্ঠ মাসে গর্ভপাত আশঙ্কা দূর করে।
বিসর্প। —বিসর্প বা ইরিসিপেলাস সাধারণতঃ ডানদিকেই বেশী দেখা দেয়, স্থানটি হঠাৎ ফুলে উঠে, তারপর ঐ ফুলাটি ক্রমশঃ বেড়ে চলে, সেই সঙ্গে জ্বর আক্রান্ত স্থানটি প্রথমে ঘোর লাল, পরে গোলাপী রং হয়ে থাকে। হুলফোটান বেদনা ও জ্বালা বিদ্যমান থাকে। রোগী কিছুতেই গরম সেঁক দিতে চায় না, অনবরত ঠান্ডা চায়। এপিসের আক্রান্ত স্থানটি টিপলে সেখানে টোল পড়ে। সদৃশ।- রাসটক্স –এপিসে তন্দ্রাভাব বা নিদ্রালুতা আছে, কিন্তু রাসটক্সে অস্থিরতা প্রবল। এপিস রোগী গরম সেঁক সহ্য করতে পারে না, রাস টক্সের বেদনা গরমে উপশম হয়। ল্যাকেসিস – রোগ বামদিক হতে ডানদিকে চালিত হয়, আর এপিসের রোগ সাধারণতঃ ডানদিক হতে বাম দিকে যায়। ল্যাকেসিসে রোগের বৃদ্ধি ঘুমের পর। বেলেডোনা – প্রথম অবস্থায় যখন অত্যধিক দপদপানি, যন্ত্রণা ও গাত্রদাহ থাকে।
আমবাত।—তরুণ বা পুরাতন আমবাত, যে সকল আমবাত ঠান্ডা লেগে অথবা সবিরাম জ্বরের পর হয়, চুলকানি, জ্বালা ও হুলফোটান ব্যথা থাকে এবং আক্রান্ত স্থানটি যদি দাগড়া দাগড়া মত হয়, ঠান্ডায় উপশম। চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়া খাওয়ার পর আমবাত হলে আর্টিকা-ইউরেন্স ফলপ্রদ। প্রায় সকল প্রকার আমবাতেই আর্টিকা-ইউরেন্স উপযোগী। ঘুমালে উদ্ভেদ মিলাইয়া যায়, রোগীর জাগিবার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় বের হয়। বেদনা, জ্বালা এবং চুলকানি প্রধান লক্ষণ। ডাল্কামারা- পুরাতন আমবাত, শীত পড়লে আরম্ভ হয় এবং সমস্ত শীতকালে থাকে। বোডিষ্টা— উদরাময়ের সঙ্গে আমবাত। পালসেটিলা – মাংসাহার আমবাতের কারণ। অ্যাসেটিক—ঠান্ডায় বৃদ্ধি, উত্তাপে উপশম, নীরক্ত অবস্থা।
মূৰ্চ্ছাবায়ু। – হিষ্টিরিয়া রোগে এপিস ব্যবহৃত হয়। রোগিণী তর্ক করে, তর্ক করাই তার স্বভাব, অত্যন্ত চঞ্চল এবং হঠাৎ রেগে উঠে। রোগিণীর কামেচ্ছা অত্যধিক। জিনিষপত্র হাত হতে পড়ে যায় এবং লজ্জিত না হয়ে হাসিতে থাকে। তুলনীয়।—অ্যাসাফিটিডা–পেট ফোলে, পেটে বায়ু জমে। পুরাতন শ্বেতপ্রদর এবং উদরাময় হঠাৎ বন্ধ হয়ে মূৰ্চ্ছা। ইগ্নেসিয়া—পাকস্থলী হতে বলের মত একটা গোলাকার পদার্থ উপরের দিকে ঠেলে উঠছে এরূপ মনে হয়। রোগিণীর কখনও হাসি, কখনও কান্না। অত্যন্ত বিমর্ষ এবং দুঃখিত, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। মক্কাস—কখনও হাসি, কখনও কান্না। অবসাদ এবং ঘুম ঘুম ভাব বেশী। ভ্যালেরিয়ানা—এটাতেও হাসি-কান্না পৰ্য্যায়ক্রমে উপস্থিত হয়। মেজাজ পরিবর্তনশীল, কখনও উদ্ধত, পরক্ষণেই বিনীত নম্র
মেনিঞ্জাইটিস।—শিশুর মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় এবং ঘুমাতে ঘুমাতে হঠাৎ বিকট চীৎকার করে উঠে। মাথার ভিতর হুলফোটান ব্যথা হয়। চোখের নীচের পাতা ফুলে একটি থলির মত হয়, তলপেটে টাটান ব্যথা অনুভব করে। প্রস্রাব হয় বন্ধ হবে, না হয় ২/৪ ফোঁটা লাল লাল প্রস্রাব হবে। জিঙ্কাম-মেটালিকাম—চর্মরোগ রুদ্ধ হয়ে বা দাঁত উঠবার সময় এই রোগ। রোগীর সংজ্ঞাহীনতা অত্যধিক, মাথাচালার সাথে ঘুমের ভিতর চমকিয়ে উঠে, সেইসঙ্গে পা দুইখানি অনবরত নাড়িতে থাকে। বেলেডোনা – মেনিঞ্জাইটিসের প্রথম অবস্থায় যখন জ্বরে গাত্রোত্তাপ খুব বেশী, অনাবৃত স্থানে ঘাম; চোখ, মুখ ও সর্বাঙ্গ রক্তাভ, গ্রীবাদেশীয় ধমনী দপ্ দপদপ্ করে, মাঝে মাঝে চম্কাইতে থাকে। হেলিবোরাস—বিকারের ভাব, মাথা এ-পাশ ও-পাশ নাড়িতে থাকে, একটি হাত ও একটি পা অনিচ্ছাসত্ত্বেও নড়ে, চামচে করে পানি পান করাবার সময় চামচ কামড়িয়ে ধরে, সর্বদাই যেন কি চিবাচ্ছে। গ্লোনইন—এটার লক্ষণসমষ্টি প্রায় বেলেডোনার মত। ক্রোধজনিত, প্রখর রোদভোগ জনিত ও মেনিঞ্জাইটিস হলে সেটা উপযোগী।
বসন্ত।—বসন্তের উদ্ভেদ বসে যাবার পর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় বা সামান্য ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব হয়। এটার রোগীর পিপাসা থাকে না ও গরম সহ্য করতে পারে না। কখনও বিসর্পের মত হয়ে সমস্ত শরীর ফুলে উঠে সমস্ত শরীরে হুল-ফোটান বেদনা অনুভব করে। গলার ভিতর খুব বেদনা, সেটা ঠান্ডায় উপশম হয়। অ্যান্টিম-টার্ট বসন্তের গুটি বের হয়ে বা লাট খেয়ে মুখমন্ডল নীলবর্ণ হয় (এপিসের মুখমন্ডল লালাভ হয়)। গা-বমি-বমি ও বমন, সাদা লেপাবৃত জিহবা, বুকে ঘড়ঘড় শব্দ, নাকের পাখা উঠা নামা করা ইত্যাদি লক্ষণ বিদ্যমান থাকে। আর্সেনিক রোগী অতি শীঘ্র শীঘ্র দুর্বল হয়ে পড়ে। মৃত্যুভয়, কুটকুটানি, সর্বাঙ্গে জ্বালা, প্রবল পিপাসা, ক্ষীণ নাড়ী।
উদরাময়।—এপিস উদরাময় ও শিশু-কলেরা-ক্ষেত্রে উপযোগী। এপিসের সকল লক্ষণের বৃদ্ধি যদিও বৈকাল ৩টায়, কিন্তু উদরাময়ের বৃদ্ধি সকাল বেলা। প্রধান লক্ষণ—পিপাসার অভাব, জ্বালা ও হুলফোটান ব্যথা; অসাড়ে মলত্যাগ, মলদ্বারটি দেখে মনে হবে যেন এটা খোলাই আছে। তলপেটে হাত দিলে রোগী চমকিয়ে উঠে। এপিসের মল খুব পাতলা, রোগী একটু নড়াচড়া করলেই মলত্যাগের বেগ হয় (ব্রাইয়োনিয়া), পুরাতন উদরাময়ে প্রস্রাব বন্ধ বা প্রস্রাবের পরিমাণ খুব কম থাকে।
ডিফথিরিয়া। রোগীর গলার ভিতর ফুলে; আজিহবা, টন্সিল ও এটার আশ-পাশের সমস্ত স্থান ফুলে যায়; আল্জিহবা ও টন্সিল জলভরা থলির মত দেখায়। জিহবার চারিধারে ফোস্কার মত হয়, সেইসঙ্গে গলার ভিতর হুলফোটানো যাতনা হয়। তন্দ্রালুতা; মূত্রের অভাব বা মূত্ররোধ দেখা যায়। আক্রমণ সাধারণতঃ ডান দিকেই বেশী হয়। লাইকোর আক্রমণ ডানদিক হতে বামদিকে, ল্যাকেসিসের আক্রমণ বামদিক হতে ডানদিকে, আর ল্যাক-ক্যানে প্রথম একদিক আক্রান্ত হয়ে অতি দ্রুত অন্যদিকে চলে যায়, পুনরায় ঘুরে ঐ দিকে আসে; এপিসের আক্রমণ ডানদিকেই আবদ্ধ থাকে।
প্রস্রাব।—মূত্রদ্বারে অত্যন্ত চুলকানি ও বার বার বেগ, কিন্তু প্রস্রাব বের হতে চায় না, অনেক কোঁথের পর ২/১ ফোঁটা প্রস্রাব বের হয়। প্রস্রাব গাঢ় লালবর্ণের, অত্যন্ত গরম; কখন কখনও রক্তমিশ্রিত। প্রস্রাবে প্রচুর অ্যামেনের জন্য শোথ। তুলনীয়। – বেলেডোনা প্রস্রাব লাল এবং গরম, কখন কখনও ঘোলাটে হয়, পরিমাণ কখনও অল্প কখনও বেশী। অ্যানাম্বিয়াম — প্রস্রাব ঘোলা এবং ঘন শ্লেষ্মাযুক্ত, এপিসের মত এটাতেও সর্বদা বেগ থাকে। পথ চলবার সময়ে বা নিদ্রিতাবস্থায় অসাড়ে প্রস্রাব হয়। অ্যামন-বেঞ্জোয়িক প্রস্রাবে এলবুমিন এবং তজ্জনিত শোথ, পরিমাণেও অল্প হয়, কিন্তু এতে ঝাঁজালো কটু গন্ধ থাকে, যা এপিসে নেই। ইয়োনাইমিন— প্রস্রাবে এলবুমেন, প্রস্রাব পরিমাণে অল্প হয় এবং সেজন্য শোথ দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট।
প্লুরিসি। —বক্ষে রস সঞ্চয়ের পর এই ঔষধ কাজে লাগে। বুকে হুলফোটান জ্বালা, ঠান্ডায় প্রীতি, চোখের নিম্নপাতায় শোথ। বেলা ৩টায় উত্তাপের বৃদ্ধি।
প্রাদাহিক জ্বরে। – তন্দ্রাভাবটি প্রবল, রোগী সকল সময়ই ঘুমাতে চায়, পিপাসা থাকে না, তবে কোন কোন রোগীর ব্রাইয়োনিয়ার মত অনেকক্ষণ পরে পরে পিপাসা হতেও দেখা যায়। রোগী গায়ে ঢাকা সহ্য করতে পারে না, গরম ঘরে উপসর্গের বৃদ্ধি ও ঠান্ডায় উপশম হয়। জিহবা শুষ্ক। বেলা ৩টায় বৃদ্ধি। প্রাদাহিক জ্বরের অন্যান্য ঔষধ – অ্যাকোনাইট, বেলেডোনা, জেলসিমিয়াম প্রভৃতি, কিন্তু অ্যাকোনাইটের লক্ষণাবলী এপিসের বিপরীত। অ্যাকোনাইটের রোগীতে অস্থিরতা এবং পিপাসা বেশী, রোগী চুপ করে থাকতে পারে না। মানসিক উদ্বেগ এবং ভয়, বিশেষতঃ মৃত্যুভয় আছে। ঠান্ডা লেগে রোগের উৎপত্তি বা বৃদ্ধি, এপিসে ঠান্ডায় উপশম। জ্বরে ঘাম হয় না। বেলেডোনা – অত্যধিক উত্তাপ, মাথা গরম, গাত্রও অত্যন্ত গরম, উত্তাপের মধ্যেই ঘাম। তীব্র মাথাধরা এবং মাথায় যন্ত্রণা। জেসিমিয়াম – তন্দ্রাচ্ছন্ন, স্নায়ু-দুর্বলতার জন্য রোগী অঘোরে চুপ করে পড়ে থাকে, কথা বলতে চায় না, পিপাসাও বিশেষ থাকে।, মাথার ঘাম থাকতে পারে। ফেরাম-ফস – প্রাদাহিক জ্বরের এটা অন্যতম উৎকৃষ্ট ঔষধ। অ্যাকোনাইট এবং জেসিমিয়ামের মধ্যবর্ত্তী ঔষধ বলে অনেকে বলেন।
ম্যালেরিয়া জ্বর। ম্যালেরিয়া জ্বর প্রায়ই বৈকাল ৩টার সময় শীত করে আরম্ভ হয়; শীতের সময় কখনও বা সামান্য পিপাসা দেখা যায় (ইগ্লেসিয়া), আবার কখনও বা পিপাসা থাকে না। শীতাবস্থায় গায়ে কোন ঢাকা দিতে চায় না, ঘরের মধ্যে থাকতে পারে না, ঐ সময় সে মনে করে যেন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। শীতাবস্থার পরেই উত্তাপাবস্থা উপস্থিত হয়, উত্তাপাবস্থায় রোগীর শ্বাসকষ্ট ও বুকে ভার বোধ বেশী হয়, গায়ের জ্বালা বৃদ্ধি পায়। উত্তাপাবস্থার পরেই ঘর্মাবস্থা দেখা যায়। এপিসের ম্যালেরিয়া রোগীর সময় সময় আমবাতের মত উদ্ভেদ বের হয়ে থাকে এবং পায়ে শোথও দেখা যায়। রোগীর শরীর মোমের মত ফ্যাকাসে। ম্যালেরিয়া জ্বরে এপিসের পরে নেট্রাম- মিউর ব্যবহৃত হয়। নেট্রাম-মিউরের সাথে এপিসের পরিপূরক সম্বন্ধ।
টাইফয়েড জ্বর।—টাইফয়েড জ্বরে রোগীর মানসিক লক্ষণের বিচার করে ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। রোগী বিকারের ভিতর চীৎকার করে উঠে আবার ঘোর আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। এটার মুখশ্রী অত্যধিক ফ্যাকাসে। রোগীর শরীরের কোন স্থান উত্তপ্ত আবার কোন স্থান শীতল, ধর্মের অভাব, রোগীর দুর্বলতা এত বেশী যে বিছানায় এলাইয়া পড়ে। কোন অবস্থাতেই তার পানি পিপাসা থাকে না। জিহবা শুষ্ক ও লাল ধারগুলি ফোস্কায় পূর্ণ, জিহবা দেখেতে কাঁপে। পেটফাঁপা, পেটে খুব ব্যথা, অনেক ক্ষেত্রেই অসাড়ে তরল মল বের হয়। তলপেটে হাত ছোঁয়ালেই চম্কিয়া উঠে। রাস-টক্স ঔষধটিতেও তরল মল লক্ষণ আছে, কিন্তু এপিসের পূর্বে বা পরে রাস-টক্স প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য নয়। তুলনীয়। –ব্যাপটিসিয়া—বাহ্যে প্রস্রাবে দুর্গন্ধ, তরল মল, পচা গন্ধ। বিকার, আচ্ছন্ন ভাব, কিছু জিজ্ঞাসা করলে ঠিক উত্তর দিতে পারে না। উত্তর দিতে দিতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে, সমস্ত শরীরে বেদনা, বিকারে অসংলগ্ন প্রলাপ। আর্ণিকা – এতে সর্বশরীরে বেদনা আছে। বিকার, কিছু জিজ্ঞাসা করলে রোগী ঠিক উত্তর দেয়; কিন্তু পরক্ষণেই আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জেলসিয়াম-তন্দ্রালুতা এবং আচ্ছন্নভাব বেশী, এতে প্রলাপ বিশেষ নেই। ব্রাইওনিয়া–বিকারে রোগী দৈনিক কাজকর্ম বা ব্যবসায় সংক্রান্ত প্রলাপ বকে। গাত্রবেদনার জন্য রোগী নড়াচড়া করতে চায় না, চুপ করে পড়ে থাকে। ব্যাপটিসিয়ায় দুর্গন্ধ ‘মলবিশিষ্ট উদরাময়, ব্রাইওনিয়ার কোষ্ঠবদ্ধতা, জেসিমিয়ামে সামান্য কোষ্ঠবদ্ধতা বা উদরাময় থাকতে পারে; রাস- টক্সেও উদরাময় আছে।
স্কার্লেটিনা।—উদ্ভেদগুলি সম্পূর্ণ প্রকাশ না পেয়ে দেহ লাল হয়ে উঠে। গাত্রতাপ অত্যধিক, রোগী অজ্ঞান, প্রস্রাব বন্ধ। উদ্ভেদ বিলুপ্ত হয়ে পক্ষাঘাত লক্ষণ।
বাত। তরুণ বাতরোগেও এপিস ব্যবহৃত হয়, বাতের স্থান ফুলে পাংশুবর্ণ ধারণ করে, সেখানে টিপলে টোল পড়ে; ভয়ানক টাটানি, টেপা সহ্য হয় না, হুলফোটান বেদনা থাকে, বেদনা নড়াচড়ায় বাড়ে, আক্রান্ত স্থানে গরম সেঁক সহ্য করতে পারে না, গরম ঘরে রোগ বাড়ে। কখন কখনও অসাড় ভাব দেখা যায়। আক্রান্ত গ্রন্থি গোলাপী বা ফিকে লাল, জ্বালা, হুলফোটান ব্যথা; নড়াবড়ায় বৃদ্ধি। ঠান্ডা হাওয়া ভাল লাগে ও তাতে উপশম। বেলা ৩টার সময় জ্বর ও সকল কষ্ট বাড়ে। সদৃশ ঔষধ —কচিকাম – কোমরে এবং সন্ধিসকলে বেদনা এবং ফোলা। টানা-ছেঁড়ার মত বেদনা, স্পর্শ সহ্য হয় না, স্পর্শ করলেই রোগী চিৎকার করে উঠে। এটার বিশেষ লক্ষণ এই যে রোগী রন্ধিত খাদ্য বা রন্ধনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ব্রাইওনিয়া—হাঁটু, সন্ধি বা অন্য স্থানে বাতবেদনা, শক্ত এবং লালবর্ণ, কাটা-ছেঁড়ার মত বেদনা, সঞ্চালনে বৃদ্ধি। রাস-টক্স–বেদনা সঞ্চালনে উপশম, বিশ্রামে বৃদ্ধি। ঠান্ডায় বৃদ্ধি, গরমে উপশম।
হৃদরোগ।— হৃপিন্ডের রোগজনিত নানাপ্রকার শোথ ও উদরী রোগ। সেইসঙ্গে বুক ধড়ফড়ানি, বুকে খোঁচামারা ব্যথা; সর্বশরীর, বিশেষতঃ চোখের নীচের পাতা ফুলে যাওয়া, নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট। এখানে নেট্রাম-মিউর, সাম্ফার ও আর্সেনিক এপিসের সমতুল্য ও সহকারী ঔষধ। এপিসের পূর্বে বা পরে নেট্রাম-মিউর সর্বদাই ব্যবহৃত হয়। সালফার – এপিসের অনুপূরক। জ্বালা, মূত্রকৃচ্ছতা প্রভৃতিতে এপিসের পর সাল্ফার প্রয়োগ করলে রোগ শীঘ্র আরোগ্য লাভ করে। আর্সেনিক – যদিও এপিস ঠান্ডা চায়, আর্সেনিকের যন্ত্রণা গরমে উপশম হয়—তথাপি এপিসের পর আর্সেনিক কাজে আসে। কারণ রোগীর লক্ষণের পরিবর্ত্তন বহুক্ষেত্রেই দেখা যায়; শৈত্যকামী শেষে তাপাভিলাষী হয়ে পড়ে।
সম্বন্ধ —অনুপূরক—নেট্রাম-মিউর। শোথরোগে—অ্যাপোসাইনাম, আর্সেনিকাম তুল্য; টাইফয়েড জ্বরে—আর্সেনিক; মস্তিষ্কের রোগে বেলেডোনা, ব্রাইওনিয়া ও ব্রোমিয়াম তুল্য; জ্বালায় — ক্যান্থারিস, আর্সেনিক, ক্যাপ্সিকাম তুল্য; আমবাতে—ডাল্কামারা, নেট্রাম-সাম্ফ, অ্যানাকার্ডিয়াম তুল্য; চোখের রোগে—পালস, রাস টক্স তুল্য; বিসর্পরোগে—রাস-টক্স, ল্যাকেসিস ও আর্সেনিক তুল্য ঔষধ। দোষঘ্ন।— নেট্রাম, ইপিকাক, ল্যাকসিস, ‘লেডাম।
বৃদ্ধি।— গরমে; বিকাল ৩টায়; ঘুমের পর; পানিতে ভিজে; ছুঁইলে; চপ দিলে; সকালে (উদরাময়)।
হ্রাস। ঠান্ডা পানিতে; ঠান্ডা বাতাসে; গায়ের কাপড় ফেলে দিলে; সোজা হয়ে বসলে।
শক্তি।–৩x, ৬, ৩০, ২০০ বা তদূর্দ্ধ।