ঈথুজা-সিনা পিয়াম (Aethusa Cynapium)

পরিচয়।—এটার অপর নাম গার্ডেন-হেমলক বা কুকুরবিষ।

ব্যবহারস্থল।–যে সকল শিশু দুধ মোটেই সহ্য করতে পারে না, তাদের পক্ষে এটা বিশেষ উপকারী। শিশু-কলেরা, আক্ষেপ, উদরাময়, হিক্কা, মস্তিষ্কের ক্লান্তি, শৈশবকালীন পক্ষাঘাত, মৃগী, হিষ্টিরিয়া, অনিদ্রা ও চোয়াল-আঙ্কান রোগে ফলপ্রদ।

প্রদর্শক লক্ষণ।—দুধ সহ্য হয় না। দুধ পান করিবামাত্র বা অল্পক্ষণ পরেই বমি হয়ে যায়। শিশু দুধ যেমন খেয়েছিল নাক-মুখ দিয়ে সেটা তেমনি অবস্থায় উঠে যায়। অথবা দুধপানের পর বড় বড় দইয়ের ডেলার মত পদার্থ বমন। গা-বমি-বমি থাকে না; অথচ বমি হয়। বমির পর শিশু অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গাঢ়ভাবে নিদ্রিত হয়। কিন্তু যেমন ঘুম ভেঙে যায় অমনি শিশু ক্ষুধায় অস্থির হয় ও খায়। ঘুমাতে ঘুমাতে চমকিয়ে উঠে। শরীর ঠান্ডা ও শরীরে চট্‌পটে ঘাম। মলত্যাগ করার পর দুর্বলতা ও ঘুম। বমির পর দুর্বলতা ও ঘুম। তড়কার পর দুর্বলতা। গ্রীষ্মকালের রোগ (শিশুদের) মুখমন্ডলে উৎকণ্ঠার লক্ষণ দেখা যায়, কষ্টের চিহ্ন দেখা যায়। মুখ সেঁটে থাকে। মুখ দেখলেই বোধ হয় তার খুব কষ্ট হচ্ছে (আর্স)। শিশুর পিপাসা নেই, কিন্তু ক্ষুধা যথেষ্ট। রোগ যতই বাড়তে থাকে রোগী ততই একলা থাকতে পছন্দ করে ও ক্রন্দনশীল হয়ে পড়ে। তরকায় চোখের তারা দুইটি নীচের দিকে নেমে পড়ে। হাত মুঠো হয়ে যায়। হিষ্টিরিয়া রোগিণী মনে করে ঘরের মধ্য দিয়ে একটি ইঁদুর দৌড়ে গেল (ক্যাল্কেরিয়া-কার্ব)। রোগী অচেতন, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। নড়াচড়ায় বৃদ্ধি, ঘুমের পর বৃদ্ধি, খোলা বাতাসে উপশম। ডান কান হতে হলদে স্রাব। কানে শিস দেওয়ার মত শব্দ (hissing). কানে আঙ্গুল গুঁজিয়া দিয়ে কানের গর্ভ চওড়া করে দেয়। মুখ খুব শুষ্ক। মুখে ঘা, লালা পড়া। জিহবা খুব লম্বা, মনে হয় যেন দাঁতে এসে লাগে। রোগী বলে তার পেট খুব ঠান্ডা। হাত দিলেও খুব ঠান্ডা বোধ হয়। পা ঠান্ডা। বুক কষ্ট ও তাতে রোগী কথা বলতে পারে না। যেন একটি তার দিয়ে বুক চেপে বাঁধা আছে। সমস্ত শরীরে কাল বা নীল দাগ। জ্বর। পিপাসা আদৌ থাকে না। খুব উত্তাপ। যখন ঘাম হয় তখন গায়ের ঢাকা খুলতে চায় না। ভোর তিনটা হতে চারটার মধ্যে বৃদ্ধি। গরম পেলে শরীরের উদ্ভেদগুলি চুলকায়।

মন। —ঈথুজা-শিশুর বৃদ্ধি একটু জড়-প্রকৃতির। শ্রমক্লিষ্টা স্নায়বিক প্রকৃতির স্ত্রীলোকদের মধ্যেও ঈথুজার রোগিণী দেখা যায়। এই ঔষধে মনঃসংযোগহীনতা প্রধান মানসিক লক্ষণ। ডাঃ গারেন্সি বলেন–শিশুদের ও অনেক সময় বয়স্কদের মানসিক যন্ত্রণার আতিশয্য ও ক্রন্দন এই ঔষধের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ—রোগ যত বাড়তে থাকে রোগী তত নির্জনতাপ্রিয় ও রোদনপরায়ণ হয়। উল্লিখিত মানসিক লক্ষণে ঈথুজা প্রয়োগে জনৈক যুবক পুনরায় পড়াশুনায় মন দেয় ও পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়।

শিশুদের বমন।— ঈথুজা শিশুদের বমন রোগে একটি বিশিষ্ট ঔষধ। শিশুর দুধ কিছুতেই সহ্য হয় না, দুধ পানমাত্রই বা কিছুক্ষণ পরেই দধির মত বা ছানাকাটা দুধ বমি করে ফেলে। বমির পর শিশু অবসন্ন ও নিদ্রিত হয়ে পড়ে, নিদ্রাভঙ্গের পর পুনরায় ক্ষুধা পায় ও খাওয়ার জন্য বায়না ধরে, কিন্তু খাওয়ার পরমুহূর্ত্তেই পুনরায় বমি করে পূর্ববৎ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

সদৃশ ঔষধ। – অ্যান্টিম – টার্ট—অ্যান্টিমের জিহবা শ্বেতবর্ণের ময়লাযুক্ত ঈথুজায় সচরাচর এরূপ জিহবালক্ষণ থাকে না। ঈথুজার উদরাময় বা পেটের দোষ গ্রীষ্মকালেই বেশী হয়, আর অ্যান্টিম-টার্টে উদরাময় বর্ষায় ও আর্দ্র ঠান্ডায় বৃদ্ধি পায়। বমির সঙ্গে সঙ্গে কপালে ঠান্ডা ঘাম হওয়া অ্যান্টিমের বিশেষ লক্ষণ। ঈথুজার শিশুর ঘুম ভাঙলেই ক্ষুধা পায়, অ্যান্টিম টার্টের শিশুর আহারের ইচ্ছা মোটেই থাকে না। অ্যান্টিম- ক্রুড—শিশুদের মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ, খিটখিটে; গায়ে হাত দিলেই রেগে যায়; জিহবার উপর পুরু সাদা ময়লা থাকে। ঈথুজার ঐরূপ কোন লক্ষণ নেই। অ্যান্টিম-ক্রুডের রোগীও পানাহারের পর বনি করে সভ্য তবে বমির পরে ঈথুজার শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ে না। ক্যাঙ্কেরিয়া—ঈধুজা ও ক্যাঙ্কেরিয়া শিশুর পার্থক্য নির্ণয় করা শক্ত। এদের পার্থক্য এই যে, ক্যাল্কেরিয়া-শিশুর বাহ্যে ও বমিতে টকগন্ধ থাকে ও মাথায় প্রচুর ঘাম হয়। আর ক্যাল্কেরিয়ায় ঈথুজার শিশুর মত খাওয়ার চেষ্টা নেই। ইপিকাক—ইপিকাক-শিশুর বমি, সর্বদাই গা-বমি-বমি বা বমন করার ইচ্ছা ও খেঁচুনি আছে, কিন্তু ঈথুজার মত খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা নেই। ঈথুজার শিশু বমনের পর ঘুমিয়ে পড়ে, ইপিকাক- শিশুর ঘুম-ঘুমভাব ত নেই-ই বরং তার অস্থিরতা আছে।

ছোট শিশুদের তড়কা বা খেঁচুনি।–ছোট শিশুদের খেঁচুনি রোগে ঈথুজা একটি মূল্যবান ঔষধ। খেঁচুনির সময় শিশু হাত মুঠো করে, শরীর শক্ত হয়, চোখ দুইটি স্থির ও চোখের তারা দুইটি নীচের দিকে ঘুরে যায়, মুখে ফেনা উঠে, দাঁত-কপাটি লাগে, নাড়ী দুর্বল ও দ্রুত হয়। ঈথুজার খেঁচুনির সাথে বমনলক্ষণ সর্বদাই থাকবে। শিশুদের দাঁত উঠবার সময় সাধারণতঃ উল্লিখিত উপসর্গ দেখা যায়। ঈথুজা প্রয়োগের পর সম্পূর্ণ নিরাময় না হলে, সোরিণাম বা সালফার।

সদৃশ ঔষধ। —সিকুটা, শিশুদের তত্কার অন্যতম উৎকৃষ্ট ঔষধ। দাঁত উঠবার সময়ে বা ক্রিমির জন্য তড়কায় বিশেষ উপকারী। মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠে, ঘাড় এবং মাথা পিছনের দিকে বেঁকে যায়, ভীষণ প্রকৃতির তড়কা। কিউপ্রাম-মেট —ঈথুজার মত শিশু হাত মুঠ করে কিন্তু এতে বমন নাহ্। আঙ্গুল ঘুরে মুঠা বাঁধিয়া যায়, মুখমন্ডল নীলবর্ণ ধারণ করে। বেলেডোনা – প্রবল জ্বর, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চয়, চোখ-মুখ রক্তিমবর্ণ। স্কুটেলিরিয়া—শিশুর দাঁত উঠবার সময়ের তড়কায় অনেক সময়ে বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে স্নায়ুর উত্তেজনা দেখা যায়।

শিশুদের পক্ষাঘাত। যে সকল শিশুর দুধ সহ্য হয় না, তাদের পক্ষাঘাত হলে এই ঔষধ বিশেষ কার্যকরী। ডাঃ ন্যাশ এই সকল ক্ষেত্রে ২০০ শক্তি প্রয়োগ করে যথেষ্ট উপকার পেয়েছেন।

শিশু –কলেরা।—এটার কলেরা সাধারণতঃ গ্রীষ্মকালেই বেশী হতে দেখা যায়। ডাঃ গারেন্সি বলেন—শিশু-কলেরায় ঈথুজা একটি বিশেষ কার্যকরী ঔষধ। এতে মলত্যাগের পরও বেগ ও কোথ থাকে। এটার বাহ্যেতে কোনরূপ গন্ধ থাকে না বা পানিপিপাসা হয় না, শিশু মলত্যাগের পর অভ্যন্ত নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। শিশু হতে হতে ছটফট করতে থাকে ও তার যেন যন্ত্রণা হচ্ছে এরূপ ভাব দেখায়। শিশু-কলেরায় যখন ভেদ-কমন হয়ে নাড়ী ক্ষীণ হয় বা লুপ্ত হয়ে যায়, তখন মনে হবে এটা বুঝি আর্সেনিকের রোগী। কিন্তু আর্সেনিকে পানিপিপাসা খুব, ঈথুজায় মোটেই নেই।

শিশু-কলেরার কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনীয় ঔষধ :-ক্রিয়োজোট –অনবরতই বমন এবং দুর্গন্ধ ভেদ হতে থাকে, সবুজ মল অথবা রক্তাক্ত, কালচে বাদামী রঙের। দাঁত উঠবার সময়ের কষ্ট থাকে। শিশুর পোকা ধরা দাঁত থাকলে এটা অধিকতর উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়। এন্টিম- ক্রুড লক্ষণ অনেকটা ঈথুজার মত, ছোট চাপযুক্ত দুধ-বমি (নষ্ট দুধ বা দই-এর মত)। বমনেচ্ছা বা সর্বদা গা-বমি-বমি এবং ওয়াডোলা থাকে। জিহবায় দুধের মত সাদা পুরু কোটিং এটার বিশেষ লক্ষণ। অ্যাসিড-কার্ব—চাউল ধোয়া পানির মত অথবা পচা ডিমের মত দাস্ত, মল অনেক সময়ে রক্ত ও আমযুক্তও হয়। অস্থিরতা, শিশু হতে হতে চীৎকার করে। ইপিকাক – থুথুর মত ফেনামিশ্রিত সবুজ রঙের মাস বা শেওলার মত মল, বমনেচ্ছা বা গা-বমি-বমি ভাব এবং কান, পেটে বেদনা বা কামড়ানি। আর্জেন্টাম নেইট্রিকাম – শিশু কলেরায় একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। যারা অত্যন্ত মিষ্টি খেতে চায় কিন্তু মিষ্টি খেলেই অসুখ করে তাদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। পথ্যের পরে বা পানি পান মাত্রই মলত্যাগ হয়; ফড়ফড় শব্দের সঙ্গে মলত্যাগ। সবুজ বা হরিদ্রাবর্ণের মল। কেলি- ব্রোমেটাম – অনবরত বাহো বমি হতে হতে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ে, সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বিকার বা ইউরিমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। ক্যামোলিয়া দাঁত উঠবার সময়ের ব্যাধি, বন্‌মেজাজী শিশু; খিটখিটে। পচা ডিমের মত দুর্গন্ধবিশিষ্ট সবুজ বা হরিদ্রা রঙের মল। এটা ব্যতীত ও লক্ষণানুসারে পডোফাইলাম, সাইলিসিয়া, জিঙ্কাম-মেটালিকাম (বৰ্দ্ধিত অবস্থা, বিকার) সাঙ্কার এবং নিনা প্রভৃতি ঔষধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

গ্রীবা ও পৃষ্ঠদেশের দুর্বলতা, হিষ্টিরিয়া এবং মৃগীরোগ রোগী দাঁড়াতে বা মাথা তুলতে পারে না, সমস্ত শরীর যেন দৃঢ়বদ্ধ আছে এরূপ অনুভব করে। আক্ষেপ বা মৃগীর আক্রমণকালে হস্ত মুষ্টিবদ্ধ মুখমন্ডল আরক্তিম, দৃষ্টি নিম্নাকৃষ্ট, চোখতারকা স্থির ও প্রসারিত, মুখ হতে ফেনা নির্গমণ, চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ, নাড়ী ক্ষীণ, দ্রুত ও কঠিন, নিদ্রালুতা এবং সেইসঙ্গে ইথুজার বিশেষ প্রকারের ভ্রম-দর্শন লক্ষণ থাকে। মনে করে একটি ইঁদুর ঘরের এক কোণ হতে অন্য কোণে দৌড়ে গেল।

সম্বন্ধ।– ডাঃ টেষ্টি বলেন— এই ঔষধ সাল্ফারের সমগুণ বিশিষ্ট। দুধ-বমনে অ্যান্টিম-ক্রুড, আর্স, ক্যাল্কে, কুপ্রাম, ওপিয়াম, অ্যাসারাম ও সাইকিউটা তুল্য ঔষধ।

বৃদ্ধি।— ভোর ৩টা হতে ৪টায়; সন্ধ্যাকালে; উত্তাপে, গ্রীষ্মকালে; কফি পানে; সুরাসেবনে, বিছানার গরমে ও উপরে চাইলে।

হ্রাস। খোলা বাতাসে, সঙ্গীদের মধ্যে কথাবার্তা বললে; কানে আঙ্গুল গুঁজলে; গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে পেটে রাখলে।

শক্তি।– ৩x, ৬, ৩০ ও ২০০ শক্তি। নিম্নশক্তিই বেশী কার্যকরী।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!