ড্রসেরা-রোটাণ্ডিফোলিয়া (Drosera Rotandifolia)

পরিচয়।-অপর নাম সানডিউ। এই জাতীয় গুল্ম ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে জন্মে।

ব্যবহারস্থল।-শ্বাসযন্ত্রের উপর প্রধান ক্রিয়া। হুপিং-কাশি, হাঁপানি, শ্বাসনলী-প্রদাহ, ক্ষয়কাশি, স্বরনলী-প্রদাহ, মৃগী, ক্ষীণ-দৃষ্টি, সর্দি, রক্তস্রাৰ, হাম, বমনেচ্ছা প্রভৃতি। ড্রসেরা হুপিং-কাশির একটি প্রধান ঔষধ। যুকবদের ক্ষয়রোগে, বক্তাদের বা কথকদের গলক্ষত, স্বরভঙ্গ, গলার শুষ্কতা, স্বরনলীর শুষ্কতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সায়েটিকা ব্যথায় এই ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

প্রদর্শক লক্ষণ।-হুপিং-কাশি, মধ্যরাত্রের পর বৃদ্ধি।-শয়ন করলে কাশি। তা ছাড়া গরমে, পানে, গান করলে, হাসিলে ও কাঁদিলে কাশি আসে। কাশি গভীর ও সেইসঙ্গে স্বরভঙ্গ। কাশিতে গলার স্বরটি (ঢাকের শব্দের মত) বড়ই মোটা হয়, শূন্যগর্ভ স্বর। কাশির পর কাশি, বিশ্রাম দেয় না, রোগী দম নিতে পারে না। কাশির আগে গলার মধ্যে শুষ্ক ভাব বা মনে হয় গলার মধ্যে পাখীর পালক আছে। কাশি, সন্ধ্যায় গয়ার থাকে না। সকালে হলদে তেঁতো গয়ার। রোগী গয়ার গিলে ফেলে। কাশির সঙ্গে বমি। প্রথমে খাদ্যদ্রব্য বমি হয়, পরে মিউকাস বমি হয়। শিশু কাশির সঙ্গে পেটে হাত দেয়। পেটে আকুঞ্চন বোধ হয়। গয়ার না ভুলতে পারলে ওয়াক তোলে ও বমি করে। সূর্য্য অস্ত যাবার পরই নিদ্রালুতা, ঘুমিয়ে পড়ে। মুখমন্ডল গরম। হাত ঠান্ডা। মুখের বামদিক ঠান্ডা এবং ডানদিক গরম। কপালে ও পায়ে ঠান্ডা ঘাম। কাশির সঙ্গে সমস্ত শরীরে ঘাম। সন্ধি ও উরুদেশে পক্ষাঘাতিক বেদনা, বিছানা অত্যধিক শক্ত বোধ হয়।

মন।-ড্রসেরা রোগীর মানসিক অস্থিরতা খুব বেশী, সেজন্য সে কোন বিষয়ে অধিক সময় মনোযোগ দিতে পারে না। সামান্য কারণে রোগী বিচলিত হয়ে পড়ে। খুব গরম বোধ, সন্ধ্যাবেলা একলা থাকলে অথবা রাত্রিকালে ঘুম ভেঙে গেলে রোগী মনে ভাবে কেউ যেন তাকে পানিতে ডুবিয়া আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে (ম্যাগ ফস, রাস টক্স, সিকেলি, সাইলিসিয়া)।

হুপিং-কাশি।-হুপিং-কাশির প্রচন্ড বেগ এত ঘন ঘন হয় যে, রোগী শ্বাস গ্রহণ করার অবসর পায় না। রাত্রে শয়ন করার উপক্রমের সঙ্গে সঙ্গেই কাশির উপক্রম হয়, ঐ কাশির স্বর ঘঙঘঙে ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। রোগীর কাশতে কাশতে বুকে গলা রুদ্ধ হয়ে যায়, কাশবার সময় বুকের পাঁজরা যেন চেপে ধরে, রাত্রি ১২টার পর বা হাম বসে যাবার আগে বা পরে কাশির বৃদ্ধি। হুপিং-কাশির সাথে উদরাময় ও আমরক্ত মিশ্রিত মল থাকলেও এটা উপযোগী। তুলনীয় – কক্কাস-ক্যাক্ট-রোগী কাশতে কাশতে বুকে সকালে ৭টার ভিতর জাগ্রত হয় এবং যতক্ষণ পর্য্যন্ত প্রচুর পরিমাণে শ্লেষ্মা উঠাতে না পারে ততক্ষণ অনবরত কাশতে থাকে। সকালে বৃদ্ধি। ইন্ডিগো-দিনের বেলা রোগীর বারম্বার খুকখুকে কাশি নিয়মিতভাবে চলতে থাকে এবং রাত্রিবেলা “হুপ” শব্দযুক্ত কাশি হয়। কোরালিয়াম-রুব্রাম-এটার কাশি দিনের বেলায় ঘন ঘন হয় এবং ঐ কাশির প্রকোপ কয়েক মুহূর্ত্ত থাকে, কিন্তু রাত্রিবেলা যে কাশি হয় তা ভয়ঙ্কর, কাশির ধমকে শিশু নীল হয়ে যায়। ভাবাস্কাম-ভগ্নস্বরবিশিষ্ট ঘঙঘঙে কাশি এটার বৈশিষ্ট্য, ড্রসেরায়ও এমন দেখা যায়। ভাবাস্কামের কাশির প্রকোপ সাধারণতঃ রাত্রেই বেশী এবং শিশুদের নিদ্রিত অবস্থার কাশিতে এটা বেশী ব্যবহৃত হয়। আর্ণিকা -কাশির আগে শিশু কাঁদে (কাশির: পরে কাঁদে-ক্যাপ্সিকাম)। কাশতে কাশতে বুকে নাক ও চোখ দিয়ে রক্ত পড়ে, অনেক সময়ে মুখ দিয়েও চাপ চাপ রক্ত বের হয়। শিশু রেগে গেলেই তার কাশি বাড়ে। বেলেডোনা – প্রথমে সর্দির অবস্থা, মাথা গরম, চোখ ও মুখমন্ডল আরক্ত। আক্ষেপিক কাশি, কাশতে কাশতে বুকে চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠে। গলায় বেদনা, সেজন্য শিশু কাশির আগে কাঁদে। রাতে শয়নের পরে কাশির বৃদ্ধি। ক্যাষ্টোনিয়া-ভেঙ্কা-প্রথম অবস্থায় আক্ষেপিক কাশিতে বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়। কুপ্রাম-মেটালিকাম-আক্ষেপিক কাশি, অনেকক্ষণ ধরে চলে। কাশিতে কাশির্তে দমবন্ধের উপক্রম হয়। মুখমন্ডল নীল হয়ে যায়, শরীর কাঠের মত শক্ত হয়। সিনা – ক্রিমিরোগগ্রস্ত শিশুদের হুপিং-কাশিতে বিশেষ উপযোগী। নড়াচড়া ও কথা বলতে শিশু ভয় পায়, তাতে কাশির ঝোঁক বাড়ে। কাশতে কাশতে বুকে শিশু শক্ত হয়ে উঠে। ম্যাগ-ফস-বায়োকেমিক মতে আক্ষেপযুক্ত হুপিং-কাশির একটি বিশিষ্ট ঔষধ। ডাঃ হেল অ্যামন- পিক্রেটামকে, ডাঃ হায়লী এবং ডাঃ গিবস অ্যামন-ব্রোমাইডকে (নিম্নশক্তি বিচূর্ণ), ডাঃ যেহকার কেলি-ব্রাইক্রমিকামকে হুপিং-কাশির বিশিষ্ট বা অব্যর্থ ঔষধ (specific) বলে প্রচার করে গেছেন। অ্যাসিড-কার্বলিক ও কষ্টিকাম-অনেকে বলেন, হুপিং-কাশির প্রথম অবস্থায় অ্যাসিড- কার্বলিক এবং সেটার জোর একটু কমলে কষ্টিকাম ব্যবহারে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।

সাধারণ কাশি।-ড্রসেরা সাধারণ কাশিতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটার কাশিতে রোগীর গলা সুড়সুড় করে, সেইসঙ্গে স্বরভঙ্গ আছে এবং মাথাটি বালিশের উপর রাখলেই কাশির সূত্রপাত- এই লক্ষণটি থাকা চাই। তুলনীয়।-বেলেডোনা -শয়নে বৃদ্ধি, কিন্তু বেগটি হঠাৎ আসে হঠাৎ যায়। ক্রোটন-টিগ-রোগীর বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসতে হবে, সেজন্য রোগী চেয়ারে বসে ঘুমায়। হায়োসায়েমাস-এটার কাশিও ড্রসেরার মত, তবে এটার কাশিতে শরীরের মাংসপেশীতে অল্প-বিস্তর আক্ষেপ দেখা যায়। এটার রোগীর মোটেই ঘুম হয় না, বা ঘুমের মধ্যেই কাসে। শয়নে বৃদ্ধি, কিন্তু উঠে সিেিল কমে। বেলেডোনার কাশি শয়নে বৃদ্ধি, কিন্তু উঠে বসলেও কমে না। রিউমেক্স – এটার কাশিও শয়নে বৃদ্ধি, কিন্তু এটার প্রকৃত বৃদ্ধি, ঠান্ডা বাতাসে, এইজন্য রোগী মুখে কাপড় দিয়ে শ্বাস লয়, শরীর ঢাকিয়া শয়ন করে। কোনায়াম-দিনে কাশি থাকে না, কিন্তু সন্ধ্যার পর হতে কাশি, শুষ্ক দম আটকানো কাশি, শয়নে বৃদ্ধি। অ্যাব্রাগ্রিসিয়া- কুকুরের ডাকের মত অথবা ঢাকের বাদ্যের মত শব্দবিশিষ্ট শুষ্ক কাশি, আক্ষেপিক ধরণের গলা সুড়সুড় করে উপস্থিত হয়, রাতে বাড়ে। অ্যামন-মিউর-শুষ্ক কাশি, স্বরভঙ্গ এবং স্বরনলী মধ্যে জ্বালা, চিৎ হয়ে এবং ডানপাশে শুইলে কাশি বাড়ে। কেলি-সায়েনেটাম-রাতে বৃদ্ধিযুক্ত একপ্রকার শুষ্ক কাশি, যাহার জন্য রোগী রাতে ঘুমাতে পারে না। কেলি-ব্রোমেটাম -হুপিং- কাশির মত একপ্রকার শুষ্ক দমকা কাশি, রাতে বাড়ে। পেট্রোলিয়াম—শিশুদের শুষ্ক কাশি, শয়নের পরেই আরম্ভ হয়। কাশি মনে হয় যেন বুকের ভিতর হতে উঠে। ষ্টার্ণাম হাড়ের নীচে সূঁচফোটানো বেদনা। ফস্ফোরাস -সন্ধ্যা হতে মধ্যরাত্রি পর্য্যন্ত, বামপাশে এবং চিৎ হয়ে শুইলে, হাসিলে বা কথা বললে অথবা অপরিচিত লোক কেউ নিকটে আসিলে কসি বাড়ে। অ্যামন-ব্রোম- আক্ষেপযুক্ত শুষ্ক কাশি, গলা কুটকুট করে উপস্থিত হয়, শয়নের পরে বৃদ্ধি, তখন অনবরত কাশি হয়। পালসেটিলা -সন্ধ্যাকালে এবং রাতে শুষ্ক কাশি, উঠে বসলে কিছু কমে। সকালের কাশি ভরল এবং গয়ার শ্লেষ্মাযুক্ত (স্ফোরাসের মত)। বাম পাশে শয়নে বৃদ্ধি।

ক্ষয়কাশি।-ক্ষয়কাশির প্রথম অবস্থায় প্রকোপ রাত্রে যদি খুব বেশী দেখা যায় এবং ঐ কাশি সমস্ত রাত্রিই যদি চলতে থাকে, বিশেষতঃ সেটা যদি রাত্রি ১২টার পর হতে বেশী হয়, তবে ড্রসেরা উপযোগী ঔষধ। কাশির সাথে রক্তমিশ্রিত শ্লেষ্মা বের হতে থাকে। পুঁজমিশ্রিত গয়ারের সাথে নৈশকাশি। যক্ষ্মারোগের অবিরাম নৈশকাশি অনেক সময় এই ঔষধ দ্বারা আরোগ্য লাভ করে এবং যক্ষ্মাগ্রন্তদের শ্বাস-কাশিতেও এই ঔষধের প্রয়োগ আছে। ড্রসেরা শ্বাসনলীর ক্ষয়রোগেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। স্বরভঙ্গ, গয়ার শক্ত, বুকে বেদনা, যেন বুকের ভিতর ক্ষত হয়েছে প্রভৃতি উপসর্গ দেখা গেলে ড্রসেরার কথা ভাবা উচিত। শ্বাসনলীর ক্ষয়রোগে যে আক্ষেপিক কাশি হয়, সেটা হয়ত একবার সন্ধ্যাবেলা, না হয় দুই প্রহর রাত্রির পর আরম্ভ হয়ে থাকে। হুপিং-কাশি বা ক্ষয়রোগীর পূর্বলিখিতরূপ নির্দিষ্ট কাশির সাথে যদি উদরাময় ও আমাশয় থাকে তা হলেও ড্রসেরা দ্বারা উপকার দর্শে।

সতর্কতা।-হানেমান বলেন, প্রকৃত হুপিং-কাশি রোগে যেখানে ড্রসেরার প্রয়োজন হয়, সেখানে এটার ৩০ শক্তির একটি মাত্রা প্রয়োগ করলেই, ৭/৮ দিনের ভিতর রোগী আরোগ্য লাভ করবে। আবার কেউ কেউ এটার নিম্নশক্তি পুনঃপ্রয়োগের পক্ষপাতী। হেরিং বলেন, হুপিং-কাশি রোগে ড্রসেরা প্রয়োগের ব্যবধানকালে সাঙ্কার এবং ভিরেট্রাম প্রয়োগে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। যক্ষ্মারোগের নৈশকাশিতে ড্রসেরার পর কোনায়াম অত্যন্ত উপযোগী ঔষধ। (কোরালিয়াম-রুব- কুপ্রাম, কক্কাস-ক্যাক্টাস, ইপিকাক, সিনা, হায়োসায়েমাস)।

সায়েটিকা ব্যথা।-উরুর পশ্চাৎদিকে অবশকারী বেদনা, টিপলে বা শরীর সম্মুখ দিকে অবনত করলে ঐ বেদনা বাড়ে। বিছানা অত্যন্ত শক্তবোধ হয়। বিছানা ছেড়ে উঠলে ব্যথা কমে।

বৃদ্ধি। – মধ্যরাত্রের পর, রাত্রি ১২টায়; সন্ধ্যাকালে; উত্তাপে; গরমপানীয় পানে; বিছানায় শুইলে; সামনে হেঁট হলে; গান করলে।

শক্তি।-১x, ৩x, ৬, ৩০ ক্রম ব্যবহার্য্য।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!