আর্ণিকা মন্টেনা (Arnica Montana)
পরিচয়।—এটা এক প্রকার গাছ।
ব্যবহারস্থল। —আঘাত; কয়লার ধোঁয়া লেগে শ্বাসরোধ। টাইফয়েড জ্বরে অসাড়ে মলমূত্র ত্যাগ। কুইনিন আটকান ম্যালেরিয়া জ্বর। সর্বাঙ্গে থেঁৎলান বেদনা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটক ক্ৰমাগত একটির পর একটি উঠতে থাকে। প্রসবান্তে হ্যাঁতাল ব্যথা। বাত; সন্ধিবাত; আঘাত; পক্ষাঘাত; সূতিকা জ্বর; সংন্ন্যাস; শয্যাক্ষত; রক্তামাশয়; রক্ত-বমন; রক্তমূত্র; গর্ভস্রাব; হুপিং-কাশি; প্লুরিসি; ইত্যাদি।
প্রদর্শক লক্ষণ।— মাথা গরম কিন্তু নিম্নাঙ্গ শীতল। সর্বদা ভয় করে, পাছে কেউ তাকে ছোঁয়। সর্বাঙ্গে থেঁৎলান ব্যথা। (টাইফয়েড) চর্ম্মের নীচে কালশিরার মত দাগ। রোগী আদৌ নড়াচড়া করতে চায় না। আঘাত লাগার পর। আঘাত লাগার ফলে উৎপন্ন যে কোন রোগ। আঘাত অল্পদিন আগেই লাগুক আর বহু বৎসর পূর্বেই লাগুক। শোক, দুঃখ, অপমান, আর্থিক ক্ষতি প্রভৃতি মানসিক আঘাতের জন্য উৎপন্ন রোগ। বিছানা খুব শক্ত মনে হয়। অজ্ঞান, জিজ্ঞাসা করলে ঠিক উত্তর দেয়, কিন্তু আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সজ্ঞানে প্রলাপ বকে। কঠিন রোগ, তবু রোগী বলে তার কিছুই হয় নেই; অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রমের পর হৃৎপিন্ডের বিবর্দ্ধন বা অন্য রোগ। পুরাতন মাথা ঘোরা, সমস্ত বস্তু যেন তার চারিদিকে ঘুরিতে থাকে। চোখ খুলে রাখে, বুজিতে পারে না, বুজলে মাথা ঘোরে। দাঁত উঠাবার পর সে স্থানে টাটানি ব্যথা। মুখ বসা ও খুব লাল, ঠোঁট গরম। তামাকে অরুচি, দুধ ও মাংসে অরুচি। দুর্গন্ধযুক্ত বমি। প্রতিবার মলত্যাগের পর রোগী শুয়ে পড়ে। অধিক চীৎকার করার ফলে স্বরভঙ্গ। হুপিং-কাশি, কাশির পূর্বে শিশু কাঁদিয়ে উঠে, কাশির পর নাক হতে রক্ত পড়ে, রক্ত কাল, তরল। পেলভিস্ স্থানে থেঁৎলান ব্যথা ও তজ্জন্য সোজা হয়ে চলতে পারে না। বাত নীচের দিকে আরম্ভ হয়ে উপর দিকে উঠে। ক্রমাগত ফোঁড়া হতে থাকে, বিশেষতঃ গ্রীষ্মকালে। অনেকগুলি ফোঁড়া একই সঙ্গে হয় (crops of boils)। মল-মূত্রাদিতে পচাগন্ধ, মলে ডিমপচা গন্ধ। সেপটিক অবস্থা, রোগী এক পাশ চেপে পা গুটাইয়া পড়ে থাকে। এপোপ্লেক্সি, মুখ লাল। রক্ত বমি, মাথা গরম, অবশিষ্ট শরীর শীতল। শরীরে টাটানি। চুলকানি, শরীরের একস্থান হতে অন্য স্থানে সরেযায়। আঁচড়াবার প্রবল ইচ্ছা, দেওয়াল, বিছানা, মাথা যা পায় তাই নখ দিয়ে আঁচড়ায়। ডানদিকের নিউমোনিয়া, শরীরে টাটানি ব্যথা ও রক্তময় গয়ার। প্রসবের পর যে কোন উপসর্গের জন্যই এটা ব্যবহৃত হতে পারে। প্রস্রাব বন্ধ হওয়া বা অসাড়ে প্রস্রাব হওয়া। আমাশয়, মলবেগ পায়। অথচ হয় না। আমাশয়ের সঙ্গে প্রস্রাব বন্ধ। টাইফয়েড অবস্থায় অসাড়ে মল-মূত্র বের হয়। জিহবা লেপাবৃত, মধ্যে বাদামী বর্ণের ডোরা। পুরাতন উদররোগে আহারের পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। পিঠে ঝিন্ ঝিনে ব্যথা। নাকে ঝি ঝি ধরে; পায়ে ঝিন্ ঝিন্ ধরে। বাহুতে ঝিন্ ঝিন্ ধরে। জ্বরে অজ্ঞানে প্রলাপ বকে। ঘামে দুর্গন্ধ।
মন। —সর্বাঙ্গে থেঁৎলান ব্যথা অনুভব, সেজন্য কেউ তাকে স্পর্শ করে বা বিরক্ত করে এটা রোগী ইচ্ছা করে না। ঐ ভয়ে রোগী একাকী চুপটি করে শুয়ে থাকে। কারও সাথে কথা বলা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে চায় না যে কেউ তাকে স্পর্শ করে। মনটি দুর্বল ও বিষণ্ন, নানাপ্রকার ভয়ের ব্যাপার কল্পনা করে, নানাপ্রকার ভয়ের স্বপ্নও দেখে, স্বপ্নে চোর-ডাকাত বা নানাবিধ জন্তু- জানোয়ার দেখে চীৎকার করে।
আঘাত ও পতন।—আঘাতের ফলে ভগ্নস্থান স্ফীত ও বেদনান্বিত। মস্তিষ্ক ও পৃষ্ঠাংশের কঙ্কাসন। আঘাতের ফলে নানাপ্রকার নূতন ও পুরাতন রোগ ক্ষেত্রেও এটা ব্যবহাৰ্য্য। আঘাতের ফলে তার বাহ্যজ্ঞান রহিত হয়ে অসাড়ে মল-মূত্র ত্যাগ হচ্ছে এরূপ অবস্থায় আর্ণিকা আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রয়োগে শুভ ফল দেয়। কোন ভোঁতা অস্ত্রাদির আঘাতের ফলে থেঁৎলে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ক্ষত হওয়া লক্ষণেও ব্যবহার্য্য। রোগীর সমস্ত শরীরে অত্যধিক বেদনা, নরম গদি আঁটা বিছানাও তার কাছে অত্যন্ত শক্ত বোধ হয় (ব্যাপ্টি)। প্রদাহ ও আঘাতাদির ফলে শরীরের উপরিভাগ গরম ও নিম্নভাগ ঠান্ডা বোধ হয়। সদ্য বা বহুদিনের আঘাতাদির ফলে রক্তস্রাব বা অচৈতন্যাবস্থা। মস্তিষ্কের ভিতর রক্তস্রাব, প্রসবান্তিক রক্তস্রাব।
আঘাত লেগে বা আছাড় খেয়ে কোনরূপ রোগ হলে আর্ণিকা সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ। আঘাত লেগে কালশিরা পড়লেও আরোগ্য হয়। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের পর কোন কঠিন রোগ হলে, আর্ণিকা ব্যবহার্য্য। তবে লক্ষণভেদে রাস-টক্স বা ক্যাল্কেরিয়া প্রয়োগে সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় (ডাঃ কেন্ট)। তুলনীয়। লেডাম — আর্ণিকা ব্যবহার করে থেঁৎলান ব্যথা কিছু কমে গিয়া যখন কালশিরার দাগ পড়ে তখন লেডাম কার্যকরী। সূঁচফোঁটা, পিনফোঁটা বা অন্য কোন সূক্ষাগ্র অস্ত্রদ্বারা উপঘাতের জন্যও লেডাম শ্রেষ্ঠ। হাইপেরিকাম—কোন কোমল স্নায়ুর ভিতর কিছু ফুটে ধনুষ্টঙ্কার আশঙ্কা। ক্যালেন্ডুলা –আঘাত বা চোট লেগে কোন স্থান ক্ষত বিক্ষত হলে ও কাটিয়া গেলে। সিম্ফাইটাম –আঘাত লেগে হাড়ে কোনরূপ চোট লাগলে বা চোখের তারায় বা চোখের উপরের হাড়ে চোট লাগলে। রুটা—অস্থিবেষ্টে আঘাত। ষ্ট্যাফিসেগ্রিয়া – কোনপ্রকার ধারাল অস্ত্র, ছুরি, ব্লেড, ক্ষুর ইত্যাদিতে কাটিয়া গেলে, অস্ত্রোপচারের পর। রাস-টক্স—শরীরের সন্ধিস্থলের বন্ধনীতে আঘাতে। ক্যাঙ্কে-ফস–কোনপ্রকারে হাড় ভেঙে গেলে সিম্ফাইটাম ও এই ঔষধের নিম্নক্রম ফলপ্রদ। বেলিস-পেরেনিস – আঘাত লেগে বা পড়ে গিয়া মচকাইয়া গেলে। অ্যামন-মিউর —বহুদিন পূর্বে মচকান ব্যথা।
বাতরোগ। —নূতন ও পুরাতন যে কোন বাতরোগ, যদি পড়ে গিয়া বা আঘাত লেগে অথবা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের পর বা আর্দ্র আবহাওয়ার জন্য প্রকাশ পায়। বাতরোগী অতিশয় স্পর্শসহিষ্ণু সর্বদাই অতি সন্তর্পণে থাকে, পাছে কেউ তার আক্রান্ত স্থানে চোট লাগিয়ে দেয়। বাতের ব্যথার জন্য সে শান্তিতে শুইতে পারে না, নরম বিছানা অতিরিক্ত শক্ত মনে হয়। শীতকালে বাত। অত্যন্ত যন্ত্রণা। হৃদযন্ত্রের বাঁদিকে ব্যথা, খিট্খিটে ভাব। মাথা গরম, শরীর ঠান্ডা। আক্রান্ত স্থানে বা শরীরের নানাস্থানে নীল বা কাল দাগ। সর্ব প্রকার স্রাবে দুর্গন্ধ। তুলনীয়। – কচিকাম —হাঁটু এবং সন্ধির বাত, স্পর্শকাতরতা এত অধিক যে আক্রান্ত স্থানে হাত দিলেই রোগী চীৎকার করে উঠে। রন্ধিত খাদ্য বা রন্ধনের গন্ধ রোগী সহ্য করতে পারে না। ব্রাইওনিয়া – সন্ধি এবং অন্যস্থানের বাত, শক্ত, লালবর্ণ, সঞ্চালনে বৃদ্ধি। রাস টক্স — সঞ্চালনে এবং উষ্ণতায় উপশম, বিশ্রামে বৃদ্ধি।
হৃদরোগ।— অতি ভারী দ্রব্য উত্তোলন, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত ব্যায়াম ইত্যাদি কারণে যদি হৃদ্যন্ত্রটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং দ্রুত হৃদস্পন্দন হতে থাকে, তবে আর্ণিকা চমৎকার ঔষধ (রাস-টক্স)। হৃদযন্ত্রে টাটান ব্যথা, হৃৎপিন্ডের স্নায়ুশূল, বক্ষঃস্থলে আঘাতের ফলে হৃৎরোগ। আক্রান্ত স্থানে জামা-কাপড়ের স্পর্শও সহ্য হয় না, রাত্রে বিছানায় শুইতে কষ্ট, অনবরত স্থান পরিবর্তনের ইচ্ছা (রাস-টক্স রোগী অনবরত স্থান পরিবর্তন করলে বেদনার উপশম হয়, কিন্তু আর্ণিকায় তা হয় না)।
সন্ন্যাস রোগ।—মাথায় অধিক রক্তসঞ্চয় হয়ে বৃদ্ধদের রক্তস্রাবী সন্ন্যাসের আশঙ্কা হলে আর্ণিকা কার্যকরী। রোগীর চোখ-মুখ রক্তাভ, অচৈতন্য হওয়ার পূর্ব-পর্য্যন্ত রোগীর সর্বাঙ্গে থেঁৎলান, টাটান ব্যথা, আড়ষ্ট বোধ। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়লে, অচৈতন্য অবস্থায়ই অসাড়ে মলত্যাগ করে, মাথা অত্যন্ত গরম ও হাত ঠান্ডা (বেল) হয়ে যায়। নাড়ী পূর্ণ ও বলবান। দীর্ঘ- নিঃশ্বাস ফেলে, বিড়বিড় করে বকে। সর্বশরীরে কালশিরা পড়ার দাগ, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। বাঁদিকের পক্ষাঘাত। নাড়ী ইন্টারমিটেন্ট ও অনিয়মিত। সদৃশ। – বেলেডোনা – অজ্ঞানাবস্থা, মুখমন্ডল ও চোখদ্বয় লাল, চোখ কালিমা প্রসারিত, ক্যারোটিড এবং দুটো রগের ধমনী দপ্দপ্ করে, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চয়। গ্লোনইন—অতিরিক্ত উত্তাপ বা রৌদ্র লাগিয়ে সন্ন্যাস (বেলেডোনার মত), মুখমন্ডল ও চোখের আরক্ততা ক্যারোটিড ধমনী দপ্দপ্ করে। ওপিয়াম —মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত, জ্ঞান-শূন্যতা, অৰ্দ্ধনিমিলিত, শিবনেত্র, ঘড়ঘড় শব্দযুক্ত শ্বাস-প্ৰশ্বাস।
গরম গোটা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁড়া।–গ্রীষ্মকালে ছোট ছোট ফোঁড়া ঝাঁকে ঝাঁকে উঠতে থাকে, অত্যন্ত যন্ত্রণা ও বেদনা থাকে। আর্কটিয়াম-ল্যাপ্পাও গরম গোটার একটি ফলপ্রদ ঔষধ। আর্ণিকায় ঝাঁকে ঝাঁকে ফোঁড়া বের হয় আর আর্কটিয়ামে একটি একটি করে ফোঁ বের হয়।
শ্বাসরোধ। —আঁতুর ঘরে শিশু কয়লার ধূমে দমবন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে আর্ণিকা ফলপ্রদ (অ্যামন-কার্ব, বোভিষ্টা, ওপিয়াম)। কয়লার ধোয়ার শ্বাসগ্রহণে অচৈতন্য হয়ে পড়লে অবস্থাভেদে অ্যামন-কার্বও উপযোগী।
জ্বর।—রোগীর শীতাবস্থার পূর্বে ভয়ানক জল-পিপাসা – প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে; অন্য অবস্থায় তত পিপাসা থাকে না। শীতাবস্থায় রোগীর সর্বশরীরে কাঁপুনি; রোগীর মাথা অত্যন্ত গরম ও হাত-পা ঠান্ডা। উত্তাপাবস্থায় অত্যধিক দুর্বলতা, রোগী অঘোর অচৈতন্য অবস্থার পড়ে থাকে। অচৈতন্য অবস্থায় অসাড়ে বাহ্যে-প্রস্রাব করে সেটা অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত। রোগীর সর্বাঙ্গে আড়ষ্টভাব ও থেঁৎলান ব্যথা, সেজন্য রোগী এপাশ-ওপাশ করে এবং নিজেকে অপরের স্পর্শ হতে রক্ষা করার জন্য সাবধান থাকে। রোগীর ঢেঁকুর উঠে, তাতে পচা ডিমের গন্ধ, মুখমন্ডল হলদে, মুখের স্বাদ তিক্ত। পুরাতন ম্যালেরিয়া জ্বর, বিশেষতঃ যেখানে প্রচুর কুইনিন ব্যবহার করা হয়েছে। সদৃশ। —ইউপেটোরিয়াম –রোগীর সর্বাঙ্গে অত্যধিক বেদনা, ঐ বেদনা রোগীর হাড়ের ভিতরই অধিক। এটার শিরঃরোগও ভয়ানক, শীতাবস্থায় পিত্ত-বমন এটার নির্দিষ্ট লক্ষণ। রাস টক্স – এটার জ্বরের রোগীর সর্বাঙ্গে বেদনা থাকে। বেদনার জন্য অনবরত ছট্ফট্ করে। যত ছট্ফট্ করে ততই তার বেদনার উপশম বোধ। আর্সেনিক —সর্বাঙ্গে বেদনার জন্য রোগী অস্থির হয়, সেই সাথে মৃত্যুভয় থাকে।
জ্বর-বিকার বা টাইফয়েড জ্বরে রোগীর সর্বাঙ্গে থেঁৎলান ব্যথা এবং স্পর্শসহিষ্ণুতা অধিক থাকে। বিছানা অত্যন্ত শক্ত বোধ হয় এজন্য পার্শ্ব পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। জ্বর একটানা ভাবে চলতে থাকে। ক্রমে ক্রমে তার বিকারাবস্থা এসে উপস্থিত হয়, বিকারাবস্থায় রোগী অসাড়ে পড়ে থাকে—অসাড়েই মল-মূত্র ত্যাগ করে। কেউ কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় বটে, কিন্তু কথা বলতে বলতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রোগীর মাথা অত্যধিক গরম, শরীর ও হাত-পা ঠান্ডা। জিহবার মধ্যভাগে লম্বালম্বি ভাবে একটা বাদামি রেখা পড়ে (লাল রেখা দেখা দেয়—ভিরেট্র-ভি)। কিছু জিজ্ঞাসা করলে, সে ভাল আছে বলে, তবে কথা বলবার সময় ঠোঁট কাঁপে। শ্বাস-প্রশ্বাস খুব জোরে জোরে পড়ে। কোন খাদ্যদ্রব্য গিলতে গেলে ঘড়ঘড় শব্দ হয় (সিনা, কষ্টিকাম, কুপ্রাম) চর্মের নীচে কালশিটের মত দাগ দেখা যায়।
সদৃশ। —ব্যপ্টিসিয়া – এটাতেও গাত্রবেদনা যথেষ্ট, রোগী গাত্রবেদনার জন্য পার্শ্বপরিবর্তন করে, কিন্তু এটার সর্বপ্রকার স্রাব হতে অতিরিক্ত দুর্গন্ধ বের হয়। অজ্ঞান ও অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে আংশিক জবাব দিয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। রাস-টক্স— রোগীর শরীরস্থ প্রত্যেক পেশীতে বেদনা। নড়লে-চড়লে উপশম। রুটা—যে দিক চেপে শয়ন করে সেই দিকে বেদনা। ফাইটোলাক্কা –এতে সর্বাঙ্গে অত্যধিক বেদনা, পেশীসকলে এত ব্যথা যে কারও সাহায্য ব্যতিরেকে উঠতে পারে না।
চোখের অসুখ। —আঘাত লেগে চোখে কালশিরা পড়লে আর্ণিকা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে লেডাম ব্যবহৃত হয়। আঘাতজনিত অথ্যামিয়া। বাতজনিত আইরাইটিস, আলোক সহ্য হয় না, চোখ লাল। কষ্ট রাত্রে বেশী, গরম সেঁকে উপশম। চোখ হতে রক্তস্রাব।
শয্যাক্ষত।—বহুদিন রোগ ভোগ করার পর শয্যাক্ষত হতে এটার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রয়োগই ফলপ্রদ। পাইরোজেন শয্যাক্ষতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔষধ; কিন্তু সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ পাইরোজেন নির্দেশক। ব্যাপ্টিসিয়া, কার্বলিক অ্যাসিড, এচিনেসিয়া, ফ্লোরিক অ্যাসিড, ল্যাকেসিস, মিউরেটিক-এসিড, সালফিউরিক এসিড প্রভৃতি ঔষধও লক্ষণানুসারে বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
স্বরভঙ্গ। বক্তাদের স্বরভঙ্গের জন্যও এটা ফলপ্রদ। বক্তা এবং গায়কদের স্বরভঙ্গে, আর্জেন্টাম-মেটালিকাম, আর্জেন্টাম-নাইট্রিকাম এবং কষ্টিকামও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, হ্রাসবৃদ্ধি মানসিক এবং অন্যান্য লক্ষণ দেখে এদের পার্থক্য নির্ণয় করতে হয়।
পেশীশূল। —অতিরিক্ত পেশীর চালনার ফলে পেশীশূলের সৃষ্টি হলে আর্ণিকা উৎকৃষ্ট ঔষধ। তবে আর্ণিকায় থেঁৎলান ব্যথা থাকা চাই। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম হেতু বা নৌকা চালনার ফলে ফুস্ফুস্-বেষ্টনির প্রদাহ জন্য আর্ণিকাই সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ।
শিরোঘূর্ণন।— মাথায় চোট লাগার পর শিরোঘূর্ণনের জন্য আর্ণিকা উৎকৃষ্ট। গা-বমি-বমি সাথে মাথাঘোরা, মাথা নীচু করলে মাথা ঘোরার উপশম, কিন্তু মাথা সোজা করার সঙ্গে সঙ্গেই রোগী মনে করে তার মাথাঘোরার সাথে সমস্ত জিনিষ ঘুরছে (ব্রাইয়ো, নাক্স, কোনা)। কোনায়ামের মাথাঘোরা বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরলেই বেশী অনুভূত হয়। আঘাত জনিত মাথাব্যথা, সেই সঙ্গে অজ্ঞানভাব। মানসিক আবেগের জন্য মাথাধরা বা তার জন্য মাথার যন্ত্রণা বাড়ে। সকালে মাথা ব্যথা। মনে হয় মাথায় যেন কেউ পেরেক পুঁতিতেছে, চক্ষের উপর মাথাধরা। সবুজ বমি। চললে, সিঁড়িতে উঠলে, চিন্তা করলে, ও খাওয়ার পর মাথাব্যথা বাড়ে।
কাশি। —হুপিং-কাশিতে চোখে পানি জমা লক্ষণে আর্ণিকা একটি প্রধান ঔষধ। গলা সুড়সুড় করে শুষ্ক কাশি। রাত্রে ঘুমাতে কাশি। কাশির পূর্বে চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। বুকে টাটানি ব্যথা। শিশু কাশির পূর্বে কাঁদে। কাশির সঙ্গে চোখ খুব লাল অথবা নাক হতে রক্ত পড়ে। কাশির সঙ্গে গয়ার উঠে, তাতে রক্ত। চোখের শিরা ছিঁড়ে রক্ত জমে
বিসর্প বা ইরিসিপেলাস।—মুখে যে কোন উদ্ভেদ উঠে বিসর্প জন্মিলে আর্ণিকা ফলপ্রদ, যদি সেটাতে টাটানি ও থেঁৎলান বেদনা এবং এটার মানসিক লক্ষণ বিদ্যমান থাকে। হ্যাবিচুয়েল ইরিসিপেলাস, বহুদিন ধরে চলে, ব্যথা, ফোস্কা পড়ে, ফুলো গরম, শক্ত, চক্চকে।
সদৃশ কয়েকটি ঔষধ ও তাদের লক্ষণ। —প্রথম প্রাদাহিক অবস্থায় জ্বর, শুষ্ক গাত্রতাপ, অস্থিরতা, মৃত্যুভয় লক্ষণে অ্যাকোনাইট। প্রবল জ্বর, মাথা গরম, চোখ লাল, প্রলাপ, মুখমন্ডলে উজ্জ্বল চক্চকে লাল উদ্ভেদ লক্ষণে—বেলেডোনা।
এপিস্। —উদ্ভেদের সঙ্গে স্ফীতি। —শোথের মত, সেটাতে জ্বালা এবং হুলফুটানো বেদনা। প্রস্রাব কমে যায় এবং পিপাসা থাকে না।
ক্যান্থারিস।—বড় বড় ফোস্কা, সেটার ভিতরে জলীয় পদার্থ, অত্যন্ত জ্বালা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ এবং ফোঁটা ফোঁটা বা রক্তাক্ত প্রস্রাব, পিপাসা।
ল্যাকেসিস।—বাম অঙ্গ আক্রান্ত হলে অধিকতর উপযোগী হয়ে থাকে। গাঢ় সবুজ নীলাভ বা রক্তাক্ত উদ্ভেদ।
ম্যান্সিনেলা।— পোড়া-নাড়াঙ্গা বা ফোস্কার মত উদ্ভেদ অথবা স্পঞ্জের মত ছিদ্রযুক্ত উদ্ভেদ। রাসটক্স।—উক্ত প্রকারের উদ্ভেদ, অধিকন্তু তাতে জ্বালা-যন্ত্রণা বা চুলকানি থাকে। অত্যন্ত অস্থিরতা।
রক্তস্রাব। পূর্ববর্ণিত লক্ষণের সাথে রক্তস্রাব থাকলে আর্ণিকা ব্যবহার্য্য। রক্তের সাথে ছোট বেদনা দেখা যায়। প্রসবের পর আর্ণিকা প্রয়োগ করলে হ্যাঁতাল ব্যথা যেমন চলে যায়, সেইরূপ রক্তস্রাবও বন্ধ হয়। আর্ণিকায় জরায়ু হতে গরম রক্তস্রাব (বেল্) হয়। আঘাত বা উপঘাত অথবা প্রসবাদির পর আর্ণিকা-লোশন বাহ্যিক প্রয়োগ করা ভাল। ২০ ফোঁটা অরিষ্ট অর্দ্ধ পোয়া পানিতে মিশ্রিত করলে আর্ণিকা-লোশন প্রস্তুত হয়। হ্যাঁতাল ব্যথায় আর্ণিকা বিফলে একটিয়া রেসিমোসা। আঘাত লেগে গর্ভিণীর অধিক স্রাব হতে থাকলে বা গর্ভপাত আশঙ্কায় আর্ণিকা ব্যবহার্য্য। এক্সম্শিয়া- মাথা গরম, পা ঠান্ডা, রোগিণী সংজ্ঞাহারা, অসাড়ে মল-মূত্র বের হতে থাকে। চর্মের নীচে কালশিরা দাগ দেখা যায়। কোন প্রকার আঘাত লাগার ফলে এরূপ হলে বিশেষ উপযোগী। ফুসফুস হতে রক্তস্রাব, সাধারণতঃ আঘাতের ফলে। রক্ত ডেলা ডেলা, সহজেই উঠে বা উজ্জ্বল টকটকে লাল, সফেন শ্লেষ্মা মিশ্রিত। কাশির সঙ্গে বুকে ও মাথায় লাগে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস। অ্যাপেন্ডিক্স স্থানে টাটান ব্যথা, স্পর্শাসহিষ্ণুতা ও থেঁৎলে যাওয়ার মত যন্ত্রণা থাকে। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সাথে জ্বর থাকে। নিম্নোদরের ডান পাশে কোনরূপ চোট লেগে বা কোনরূপ ভারী দ্রব্যের আঘাত লেগে যদি অ্যাপেন্ডিক্স আক্রান্ত হয়, সর্বপ্রথম আর্ণিকার কথাই স্মরণ করা কর্ত্তব্য। মাথা গরম, শরীর ঠান্ডা। শরীরে কালসিটার দাগ। গরম সেঁকে কষ্ট কম হয়। মলে দুর্গন্ধ। মুখ হতে দুর্গন্ধ। (প্রাদাহিক অবস্থায় জ্বর, শুষ্ক গাত্রতাপ, অস্থিরতা, পিপাসা, মৃত্যুভয় লক্ষণে— অ্যাকোনাইট এবং প্রবল জ্বর, আরক্ত, মুখমন্ডল ও মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চয়, বিকার, প্রলাপ প্রভৃতি লক্ষণে বেলেডোনা ব্যবহৃত হয়)। আইরিস টেনাক্স –এই রোগের একটি বিশিষ্ট ঔষধ। আক্রান্ত স্থানে ভয়ানক বেদনা, পিত্তবমি, অবসন্নতা ইত্যাদি এটার প্রধান লক্ষণ। লক্ষণানুসারে লাইকোপোডিয়াম এবং অর্দ্ধপুরাতন অবস্থায় বেদনা বা জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে না, মার্ক-সল ব্যবহৃত হয়।
উদরাময়।– পুরাতন উদরাময়। সর্বশরীরে এবং পেটে একপ্রকার টাটানি ব্যথা। পেটফাপা, দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু নিঃসরণ, তিক্ত অম্লগন্ধ ও পচা দুর্গন্ধযুক্ত ঢেঁকুর উঠা সেই সাথে আমযুক্ত পিচ্ছিল, রক্তমিশ্রিত, দুর্গন্ধযুক্ত মল, মলত্যাগের সময় পেটে অত্যন্ত বেদনা ও কোঁথানি থাকে। অনেক সময় অসাড়ে মলত্যাগ হয়। আঘাত লেগে উদরাময়, আমাশয় প্রভৃতি হলেও আর্ণিকা ফলপ্রদ। ঘুমাতে ঘুমাতে অসাড়ে মলত্যাগ। খাদ্যে অনিচ্ছা। উদ্গারে দুর্গন্ধ।
আমাশয়।—একবার পায়খানা হওয়ার অনেক পরে দ্বিতীয়বার পায়খানা হয়, প্রায় ৪/৬ ঘন্টা পরে হয়। কাল রক্ত, পরিমাণে প্রচুর। পেটের ডানদিকে ব্যথা, বায়ু নিঃসরণে তা কম হয়। দুর্গন্ধস্রাব। মুখ হতে দুর্গন্ধ বের হয়। মাংসে ও দুধে অরুচি। মাথা গরম এবং শরীর ঠান্ডা।
প্রস্রাব। —অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য প্রস্রাব বন্ধ, প্রস্রাব করার সময় অনেকক্ষণ কোঁথ দিবার পর তবে প্রস্রাব বের হয়। মূত্রদ্বার ও মূত্রস্থলি থেঁৎলাইয়া গেছে অনুভব। প্রস্রাব পায় কিন্তু প্রস্রাব হয় না। প্রস্রাবে বাদামী রংয়ের বা সুরকির মত তলানি।
এবসেস্। ফোঁড়া পেকে আসল, কিন্তু কোন কারণে তা না ফেটে বসে যাচ্ছে। আক্রান্ত স্থানের চামড়া চুপ্সে যায়, কুঁচকে যায়। এই অবস্থায় আর্ণিকা ফোঁড়াকে পুনরায় পাকিয়ে দেয়।
বৃদ্ধি। স্পর্শে; নড়নে-চড়নে; সুরাপানে; আর্দ্র ঠান্ডায়; আঘাতে; পরিশ্রমে; ভ্রমণে; কুইনাইন সেবনে; কয়লার ধোঁয়ায়; বাঁদিকে শুইলে; ছুইলে (সর্বশরীরে)
হ্রাস।—শুয়ে থাকলে; মাথা নীচু করে শুইলে; সন্ধ্যায়; রাতে।
শক্তি।–নিম্ন ও উচ্চ উভয়বিধ শক্তিই ব্যবহৃত হয়।