কেলি-সালফিউরিকাম (Kali Sulphuricum)
পরিচয়।– পটাসিয়াম-সালফেট। এটাও একটি টিসু-রেমিডি। হোমিওপ্যাথিক মতে এই ঔষধটি অ্যান্টি-সোরিক ও অ্যান্টি-সাইকোটিক। এটা বহুল পরিমাণে পালসেটিলা সদৃশ ঔষধ।
ব্যবহারস্থল। -রক্তাল্পতা, হাঁপানি, স্বল্পরজঃ, মাথায় টাক পড়া, মস্তিষ্কের কোমলতা, দুষ্টব্রণ, মুখের পচনশীল ক্ষত, উদরাময়, কলেরা, আমাশয়, রক্তামাশয়, অসাড়ে ভেদ, মূত্রস্রাব, ফুসফুস – প্রদাহ, পায়ে ঝিনঝিনে বাত, আমবাত, সন্ধিবাত, পাকাশয়ের ক্ষত প্রভৃতি। প্রধানতঃ শরীরের উপত্বক, পৃষ্ঠ, স্তনাগ্র ও শ্লৈষ্মিক-ঝিল্লীর উপর এটার ক্রিয়া। এটার সকল স্রাবই পীতবর্ণের এবং লক্ষণাবলী উত্তাপে বৃদ্ধি লাভ করে ও মুক্ত হাওয়ায় উপশম হয়। এটার বেদনা পালসেটিলার মত এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণানুসারে পালসেটিলা প্রয়োগে সুফল না পেলে কেলি-সাম্ফ ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। বহু ক্ষেত্রে পালসেটিলা সম্পূর্ণ আরোগ্য করতে না পারলে, ২/১ মাত্রা কেলি-সাম্ফ ২০০ শক্তি আরোগ্য ক্রিয়া সম্পূর্ণ করে। উভয় ঔষধই সমলক্ষণ সম্পন্ন; প্রভেদ এই-পালসেটিলা উদ্ভিজ্জ ঔষধ আর কেলি-সাম্ফ খনিজ ঔষধ। সুতরাং কেলি-সাম্ফের ক্রিয়া গভীরতর।
প্রদর্শক লক্ষণ।– উত্তাপে রোগলক্ষণ বাড়ে ও খোলা-বাতাসে এবং ঠান্ডায় উপশম। সন্ধ্যায় বৃদ্ধি। হলদে রঙের অনুত্তেজক স্রাব। চামড়া হতে প্রচুর পরিমাণে ছাল উঠে। যন্ত্রণা নানাস্থানে ঘুরে বেড়ায়, পচনশীল বাত। জিব হলদে। পানিপিপাসা।
মন।–কেলি-সাল্ফ রোগী অতি সহজেই ক্রুদ্ধ হয়, মেজাজ ভয়ানক খিটখিটে, বড়ই একগুঁয়ে। পরিশ্রম বা লোকসঙ্গ মোটেই পছন্দ করে না। মানসিক অবস্থা বড়ই পরিবর্তনশীল (পালসেটিলা)। কিন্তু পালসেটিলার রোগী সদা ক্রন্দনশীল, অভিমানী, সে ভীত নয় এবং তার চঞ্চলতা নেই বরং সর্বকাজ ধীরভাবেই সম্পন্ন করে। এইখানেই উভয় ঔষধের মধ্যে পার্থক্য। কেলি-সাল্ফ নানা জাতীয় চর্মরোগে ব্যবহৃত হয় এবং ঐ সকল চর্মরোগ হতে আঁইস উঠে। পালসেটিলার উল্লেখযোগ্য কোন চর্মরোগ নেই। পালসেটিলা রোগীর পিপাসাহীনতা খুব বেশী অথচ জিহবা অত্যন্ত শুষ্ক। কেলি-সান্ধ রোগীর জিহবা পিচ্ছিল ও পানিপিপাসা থাকে।
মস্তক।-ভয়ানক মাথাঘোরে, বিছানা ছেড়ে উঠলে বা দাঁড়ালে মাথা ঘুরিতে থাকে, কোন উজ্জ্বল জিনিষের প্রতি তাকাইয়া থাকলে মাথা ঘুরে। এত মাথাঘোরে যে, রোগী ভয়ে ঘরের বাহিরে যেতে চায় না। মাথার যন্ত্রণা সন্ধ্যাবেলা, বদ্ধ ঘরে এবং উত্তাপে বাড়ে, শীতল বাতাসে ও মধ্যরাত্রির পর যন্ত্রণা হ্রাস হয়। কেলি-সাল্ফ রোগীর মাথায় প্রচুর খুস্কি পড়ে, খুস্কির রং হলদে এবং সেটা চুলকাইলে চটচটে হলুদবর্ণের রস বের হয়। খুস্কির জন্য রোগীর মাথার চুল উঠে যায়।
স্নায়ুশূল।– স্নায়ুশূলে ম্যাগ ফস, কলোসিন্থ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু যদি স্নায়ুশূলের বেদনা স্থান পরিবর্তন করে, বদ্ধ গৃহে, গ্রীষ্মকালে ও সন্ধ্যাবেলা বেশী হয়, ঠান্ডা হাওয়ায় উপশম লাভ করে, তা হইরে কেলি-সাম্ফ দ্বারা আরোগ্য হবেই।
সর্দি ও নাসাক্ষত। -সর্দির তৃতীয়াবস্থা। এটার স্রাব সবুজ ও হরিদ্রাবর্ণের স্রাবে বেশ দুর্গন্ধ থাকে। পুরাতন সর্দির মত ওজিনা বা পূতিনস্য রোগেও এটা ব্যবহার্য্য। পূতিনস্য রোগে রোগীর নাক বন্ধ হয়ে যায়, সেজন্য আস্বাদনশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি লোপ পায়। তুলনীয়।– পালসেটিলা -হলদে বা সবুজ রঙের গাঢ় দুর্গন্ধযুক্ত সর্দিস্রাব, রোগী ঠান্ডা মুক্ত হাওয়া চায়, গরম ঘরে উপসর্গের বৃদ্ধি, সন্ধ্যার দিকে উপসর্গের বৃদ্ধি। ব্রাইওনিয়া হলদে রঙের গাঢ় সর্দিস্রাব। তীব্র মাথাঘোরা, মনে হয় যেন মাথা ফেটে যাবে। রোগী চুপ করে থাকতে ভালবাসে। বালসামাম-পেরু-অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত, পুরাতন গাঢ় সর্দিস্রাব।
ওজিনা।-অরাম-মেট-নাক হতে দুর্গন্ধ স্রাব, নাক-অস্থির ক্ষত, নাকের অস্থিতে ছিদ্র হয়ে অস্থি টুকরা টুকরা হয়ে বের হয়, নাকয় পচা দুর্গন্ধ। অরাম-আয়োড-নাকয় কঠিন ক্ষত। হাইড্রাষ্টিস নাক হতে যেন চটচটে আঠার মত স্রাব। স্পর্শে ক্ষত হতে রক্ত পড়ে। অ্যাসিড-ফ্লুয়োর-নাকয় পক্ষাঘাত।
দন্তশূল।-কেলি-সাম্ফের দন্তশূল গরম ঘরে বেশী হয় এবং খোলা ঠান্ডা হাওয়ায় উপশম বোধ করে। খাদ্যের স্বাদ পায় না। জিহবা পীতবর্ণ ও আঠার মত শ্লেষ্মাযুক্ত।
তুলনীয়।– পালসেটিলা-গরম ঘরে, গরমে এবং মুখে গরম পানি নিলে দন্তশূলের বৃদ্ধি, ঠান্ডা হাওয়ায় উপশম। ক্যামোমিলা, ল্যাকেসিস-গরম পানিতে বৃদ্ধি। (দন্তবেদনার উপশম, ঠান্ডায়-কফিয়া, ক্যামোমিলা, ম্যাগ-কার্ব, পালসেটিলা। গরমে উপশম আর্সেনিক, ম্যাগ ফস, নাক্স ভমিকা। ঠান্ডা বাতাসে এবং ঠান্ডা পানি মুখে রাখলে – নেট্রাম-সাম্ফ)।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ। – কেলি-সাম্ফ, হাঁপানি, হুপিং-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা প্রভৃতি সকল প্রকার কাশি রোগের তৃতীয়াবস্থায় ব্যবহৃত হয়। গয়ার চটচটে, হরিদ্রাবর্ণের বা সবুজ অথবা পানির মত শ্লেষ্মাময়। কাশবার সময় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস কালে গলার ভিতর ঘড়ঘড় শব্দ হয়, প্রায় সকল প্রকার কাশির সাথেই ঘড়ঘড়ানি শব্দ শুনা যায়। সন্ধ্যাবেলা জ্বর হয়, কাশি সন্ধ্যাবেলা বা গরম ঘরে বাড়ে। হাঁপানি সাধারণতঃ গ্রীষ্মকালেই বেশী হয়। কাশির সাথে স্বরভঙ্গ থাকে।
বাতের বেদনা।– হাত-পা, কাঁধ, পিঠ ইত্যাদি শরীরের যে কোন স্থানের বাতের ব্যথা হোক না কেন, যদি বেদনা স্থান পরিবর্তনশীল হয়; সন্ধ্যাবেলা ও গরম ঘরে বৃদ্ধি এবং ঠান্ডা হাওয়ায় বা ঠান্ডা জায়গায় উপশম হয়, তবে সেটা ব্যবহার্য্য। ডাঃ কেন্ট বলেন –বাতের বেদনায় সূঁচফোটান যন্ত্রণা ও পূর্ববর্ণিত অপরাপর লক্ষণ এটার নির্দেশক।
চর্মরোগ।-চর্মরোগ বসে যাওয়ার পর গায়ের চামড়া শুল্ক ও খসখসে। একজিমা হতে হরিদ্রাবর্ণের তরল বা আঠা আঠা দুর্গন্ধ স্রাব বের হয়, এটার উপর যে মামড়ী পড়ে তাও হলুদবর্ণের। রোগীর মাথা হতে যদি খুস্কি উঠে তার বর্ণও হলদে। এটার চর্মরোগ আইসের মত একপ্রকার শল্ক উঠে। ছোট ছোট সূক্ষ্ম পীড়কাসকল পরস্পর মিলিত হওয়ায় আক্রান্ত অংশ আরক্তিম ও স্ফীত হয়। চামড়া ঘষিলে বা চুলকাইলে সেটা প্রদাহযুক্ত হয়। আমবাত রোগে এটা আর্টিকা- ইউরেন্স তুল্য।
প্রমেহ রোগ। প্রমেহ রোগের হরিদ্রাবর্ণ বা পিচ্ছিল স্রাব এটার বিশেষ লক্ষণ। পুঁজের মত স্রাবযুক্ত পুরাতন প্রমেহ বা গ্লীট রোগেও এটা একটি উত্তম ঔষধ। প্রমেহ রোগে হঠাৎ স্রাব বন্ধ হয়ে অন্ডকোষ-প্রদাহ বা একশিরা হলে উপযোগী। প্রমেহ রোগে মূত্ৰনলী হতে রক্তস্রাব, প্রস্রাব করার সময় জ্বালা, সূঁচফোটান যন্ত্রণা, প্রস্রাবে অত্যধিক দুর্গন্ধ। তুলনীয়। – পালসেটিলা – পুরাতন গ্লীট অবস্থায়, বিশেষ উপযোগী (সময়ে সময়ে প্রথম অবস্থাতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হলদে বা সবুজ রঙের পুঁজের মত গাঢ় ঘনস্রাব। ওলিয়াম-স্যান্টাম -গ্লীট ষ্টেজে প্রচুর পরিমাণ হলদে স্রাব, হলদে, ঘন পুঁজের মত স্রাব। লিঙ্গোদাম (কর্ডি) যন্ত্রণাপ্রদ। এলিউমেন-পুরাতন গ্লীট ষ্টেজে তলদে রঙের গাঢ় স্রাব। ক্যান্সিকাম – পুরাতন গ্রীট ষ্টেজের ঔষধ – দুই এক ফোঁটা চটচটে স্রাব, মূত্রনালীর মুখে লেগে থাকে। প্রস্রাবে বেশ জ্বালা-পোড়া বর্তমান। নেট্রাম-মিউর – পুরাতন অবস্থায় ব্যবহৃত হয়, প্রস্রাবের পরে টাটানি কাটাছেঁঢ়ার মত বেদনা। যারা একটু বেশী লবণ খায়, আটার রুটি মোটেই ভালবাসে না, তাদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। ন্যাফথালাইন -প্রমেহের গ্রীট অবস্থায় ঔষধ। হঠাৎ বেগের সঙ্গে কালো রঙের প্রস্রাব হয়, প্রস্রাবে ঝাঁজাল, পচা গন্ধ। জ্যাকারান্ডা- মূত্রনালীর প্রদাহের সঙ্গে মূত্রনলী দিয়ে হলদে রঙের স্রাব। থুজা – এটা যেমন তরুণ অবস্থায় তেমনি পুরাতন অবস্থাতেও বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সবুজ বা হলদে রঙের স্রাব। প্রস্রাবে জ্বালা ও বেগ, ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব, কখনও প্রস্রাবে রক্ত থাকে।
অন্ডকোষের প্রদাহ। ক্রিমেটিস-ঠান্ডা লেগে অথবা এমেহের স্রাব বন্ধ হয়ে অন্ডকোষের প্রদাহ উপস্থিত হয়। স্পার্মাটিক কর্ড ফুলে মোটা ও ভীষণ বেদনা হয়। ব্রোমিন – অন্ডকোষ ফোলে, গরম ও শক্ত হয়। ক্যাক্টেরিয়া ফুয়োরিকা-অন্ডকোষ ফোলে ও সেটাতে পানি সঞ্চয় হয়। ফাইটোলাক্কা – সেকেন্ডারী উপদংশ জন্য অথবা প্রমেহ স্রাব রুদ্ধ হয়ে অন্ডকোষের প্রদাহ, একশিরা, অন্ডকোষের ফোলা ও শক্তভাব। রডোডেনড্রন প্রমেহ স্রাব বন্ধ হয়ে অন্ডকোষের প্রদাহ ও স্ফীতি। সেটা শক্ত ও বেদনাযুক্ত হয়। স্পঞ্জিয়া- অন্ডকোষ ফোলা, শক্ত ও বেদনাযুক্ত, স্পার্মাটিক কৰ্ড ফুলে মোটা হয়; সামান্য নড়াচড়াও অসহ্য। বামদিকের রোগে অধিকতর উপযোগী।
স্ত্রীরোগ।– ঋতুর সময় প্রসব বেদনার মত বেদনা এবং জননেন্দ্রিয় জ্বালা করে। এটার প্রদরস্রাব হরিদ্রা বা সবুজবর্ণের, পাতলা অথবা পুঁজের মত চটচটে।
জ্বর।-জ্বর সন্ধ্যা হতে বাড়িতে আরম্ভ করে দুপুর রাত্রি পর্য্যন্ত বাড়ে, তারপর কমতে থাকে। জ্বরে এই ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে জিহবা এবং অন্যান্য লক্ষণ অবশ্যই দেখতে হবে। পুরাতন জ্বরে চোখ-মুখ জ্বালা করে জ্বর আসে, সেইসঙ্গে হাত-পায়েও জ্বালা হয়। অনবরত ঠান্ডা স্থান খোঁজা লক্ষণে এটা উপযোগী। পানিপিপাসা খুব, ঠান্ডা জলপান করতে চায়। তুলনীয়।-পালসেটিলা জ্ঞাপক জ্বরের লক্ষণ কেলি-সাম্ফের মত। প্রভেদ এই যে কেলি-সাম্ফে পিপাসা আছে, রোগী প্রচুর পরিমাণ ঠান্ডা পানি পান করতে চায়। পালসেটিলায় অত্যধিক গরম সত্ত্বেও পিপাসা নেই। ভারতীয় ঔষধ-অ্যাজাভিরাষ্টা, কুইনিয়া-ইন্ডিকা, কালমেঘ, সেফালেনড্রা-ইন্ডিকা, সেফালিকা বা নিকট্যান্থিস, ক্ষেতপাপড়া বা ওন্ডেনল্যান্ডিয়া, রহিতক ইত্যাদিতে পিত্তাধিক্য, জ্বালা-যন্ত্রণা বেশী দেখা যায় এবং কেলি-সাফের সঙ্গে এদের তুলনা চলে থাকে।
কলেরা।– কলেরার প্রথম অবস্থায় যখন রোগী অতিশয় অস্থিরতা প্রকাশ করে, কেবল ঠান্ডা স্থান খুঁজে বেড়ায় ও শীতল পানি পান করতে চায়। এরূপ অবস্থায় বায়োকেমিক ঔষধ ফেরাম- ফসও বিশেষ উপযোগিতার সাথে ব্যবহৃত হতে পারে। পানির মত দাস্ত এবং বমি এমন ক্রমাগত হতে হতে রোগীর চোখ-মুখ বসে যায়। পিপাসা, অস্থিরতা বা আচ্ছন্নভাব, অল্প তল্প জ্বর, ঠান্ডায় এবং ঠান্ডা পানি পানে উপসর্গের উপশম ইত্যাদি লক্ষণে ব্যবহৃত হয়। অ্যাকোনাইট- অস্থিরতা, পিপাসা, মৃত্যুভয়, গেটে তীব্র বেদনাসহ বার বার মলত্যাগ, তরমুজের পানির মত বা পিত্ত মিশ্রিত, দিনে গরম রাতে শীত এমন সময়ের ব্যাধিতে বিশেষ উপকারী। কলেরা এপিডেমিকের সময়ে ভয় পেয়ে রোগ হলে এটা অধিকতর উপযোগী হয়ে থাকে।
বৃদ্ধি।– গরমে; গরম ঘরে; সন্ধ্যাবেলা (পালস)।
শক্তি। ৩, ৬, ৬, ৩০, ২০০ শক্তি।