গ্র্যাফাইটিস (Graphitis)
পরিচয়।-কার্বো-মিনারেলিস বা কাল সীসক, চলতি কথায় সুর্মা বলে। এটা একটি গভীর অ্যান্টি-সাইকোটিক ঔষধ।
ব্যবহারস্থল।-বিভিন্ন চর্মরোগে ধাতুগত লক্ষণের দিকে দৃষ্টি রেখে প্রয়োগ করতে হয়। অর্বুদ, গুহ্যদ্বার বিদারণ, বয়োব্রণ, অর্শ, ধাতুক্ষয়, শূল মেদাধিক্য, জরায়ুর কর্কট, শ্বেতপ্রদর; ডিম্বাশয়ের রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, কর্ণমূল -প্রদাহ, গন্ডমালা-দোষ, অতিরিক্ত রেতঃপাত, ঘ্রাণশক্তির অভাব, জননেন্দ্রিয়ের বিভিন্ন রোগ, হুপিং-কাশি, ক্রিমি, গো-বীজের টিকার মন্দফল প্রভৃতি।
আকৃতি।-গ্র্যাফাইটিসের রোগী দেখতে বেশ মোটাসোটা এটার মোটা হওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। ক্যাল্কেরিয়া ও গ্রাফাইটিস এই উভয় ঔষধেই মোটা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ক্যাল্কেরিয়ার গঠন থলথলে, গ্রাফাইটিস সুগঠিত দেহ। পালসেটিলার রোগীও মোটাসোটা কিন্তু গ্রাফাইটিস শীতকাতুরে, রোগী মুক্ত হাওয়া চাইলেও মুক্ত হাওয়ার ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না, পালস শৈত্যাভিলাষী। মেয়েদের যৌবন সমাগমের রোগদিতে পালস যেরূপ উপযোগী, রজঃনিবৃত্তিকালের রোগদিতে গ্র্যাফাইটিস সেইরূপ কাজ করে। গ্র্যাফাইটিসের রোগীর নখগুলি পুরু-পুরু ও বিবর্ণ।
প্রদর্শক লক্ষণ।-চর্মরোগ, আক্রান্ত স্থান ফাটা-ফাটা ও উদ্ভেদগুলি হতে মধুর মত চটচটে রস পড়ে। স্বাভাবিক তাপের অল্পতা ও ঘামহীনতা (সোরিণ) উদরাময়, মল তরল, মলের মধ্যে গোটা গোটা খাদ্যদ্রব্য। মলে অত্যন্ত দুর্গন্ধ। মল ময়দার লেইয়ের মত, পচা ডিমঘোলানোর মত পিচ্ছিল। কোষ্ঠবদ্ধ স্বভাব, ডেলা-ডেলা মল, ডেলাগুলি সূতার নায় মিউকাসে যুক্ত থাকে। মল মিউকাসে আবৃত। মল আকারে খুব বড়। স্তনের বোঁটায়, মুখের কোণে, আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে, আঙ্গুলের ডগ ও মলদ্বার ফাটা-ফাটা। পেট শক্ত, ভরা, বায়ুতে পূর্ণ, বায়ু নিঃসরণ হয় না। কাপড় ঢিলা করে পরতে হয়। চ্যাপ্টা কাল-কাল আঁচিল। যে পাশে শোয় তার বিপরীত পাশে বেদনা (পেটে)। পেটের ব্যথা, কিছু খেলে, গরম পানীয়ে, বিশেষতঃ গরম দুধে ও শয়নে কম থাকে। মিষ্টদ্রব্য খেলে গা-বমি-বমি করে। গরম পানীয় সহ্য হয় না। মাংস খেতে চায় না। একজিমা, চোখের পাতায়, কানের পাশে, নাকে ও মুখের চারিদিকে রস পড়ে এবং ফাটা-ফাটা থাকে। মাথার খুলতে জ্বালা ও কানের ভিতর শুষ্কতা। গয়ার নোনতা। স্তনে ফোঁড়া হওয়ার পর শক্ত ক্ষতচিহ্ন ও তা হতে ক্যান্সার রোগ। হাইড্রোসিল (বামদিকে), অন্ডকোষের চর্মে দাদ জাতীয় উদ্ভেদ। মাথাধরা, সেইসঙ্গে বাহ্যে ও বাম, বরফের মত ঠান্ডা ঘাম। মাছ-মাংসে অরুচি। মুখ হতে পচা গন্ধ। মুখের কোণে বা কসে ঘা। দাড়ি ও ভ্রূর চুল উঠে যায়। মুখে ইরিসিপেলাস, ডানদিকে আরম্ভ হয়ে বামদিকে প্রসারিত হয়। নাক লাল, মাঝে মাঝে কাল-কাল দাগ। কানে কম শুনে, কানের মধ্যে শুষ্কতা, কর্ণরোগে গোলমালের মধ্যে ভাল শুনে। চোখের পাতা ভারী, চোখ খুলতে পারে না।
মন।-সদাই শঙ্কা ও সতর্কভাব; রোগী অলস প্রকৃতির, কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না। নিজের উপরেও বিশ্বাস নেই; চিঠিখানি লিখিতে তিনবার খুলে পড়ে, ঘরে তালা দিয়ে ফিরে এসে আবার দেখে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই সঙ্গম ইচ্ছার অভাব থাকে। শিশু অত্যন্ত নির্লজ্জ, গালাগালি করলেও হেসে উড়াইয়া দেয়। রোগিণীর ভাবপ্রবণতা অত্যধিক। গান শুনতে ভালবাসে না; কপালে একটা মাকড়সার জাল লেগে আছে বোধ করে। ঠান্ডা ভালবাসে না, কিন্তু দেহ বস্ত্রাবৃত করে খোলা বাতাসে থাকতে চায়। কোন কাজ করার সময় আপনা আপনিই পা নাড়াতে থাকে। গ্র্যাফাইটিস রোগীর ঋতুস্রাব অল্প, কিন্তু প্রদরস্রাব যথেষ্ট, সেজন্য বিমৰ্ষতা।
বাতরোগ।-পায়ের আঙ্গুলে রাত্রে ছিঁড়ে ফেলার মত ব্যথা, ঘুম ভেঙে যায়, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম এবং বিছানা হতে লাফাইয়া উঠে। কিন্তু খেলে কম থাকে। পায়ের আঙ্গুলের গাঁটে বাত হয়ে ফোলে ও বেঁকে যায়। পা ঠান্ডা। নাক লাল। মুখ ফুলা-ফুলা। চামড়া খসখসে। ঘাড়ের আশপাশ আড়ষ্ট। বাম কাঁধে যন্ত্রণা। হাঁটু আড়ষ্ট। শীত করে; ঘাম তেমন হয় না। চর্মরোগ, তা হতে চটচটে রস পড়ে।
হাঁপানি।-রাত্রে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ঘুম ভেঙে যায় (মধ্যরাত্রের পর)। বিছানা হতে লাফাইয়া উঠে। কিছুতে ঠেস দেয়। যা পায় তাই খেয়ে ফেলে, খেলে উপশম। কাশি, স্বরভঙ্গ। তুলনীয়।-আর্সেনিক -রাতে, বিশেষতঃ মধ্যরাত্রির পরে হাঁপানির টান বাড়ে। দমবন্ধ হয়ে আসে। বুকে চাপবোধ এবং সাঁই-সাঁই শব্দ। রোগী হুইতে পারে না, তাকে হেঁট হয়ে বসে থাকতে হয়। অ্যারেলিয়া-রেসিমোসা – শুইলেই বাড়ে, রোগীকে উঠে বসে থাকতে হয়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কিন্তু সহজে ফেলতে পারে (অস্থিরতার সঙ্গে হলে-আর্সেনিক, ব্রোমিন; নিদ্রালুতার সঙ্গে-কার্বো-ভেজ)। ক্যানাবিস-ইন্ডিকা-হৃৎপিন্ডে যন্ত্রণাসহ আক্ষেপযুক্ত হাঁপানি, বুক ধড়ফড় করে, রোগী বামদিক চেপে শুইতে পারে না। মস্কাস-আক্ষেপযুক্ত হাঁপানি, দমবন্ধের ভাব। বুকের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ সর্দি, কিন্তু তুলে ফেলতে পারে না (অ্যান্টিম-টার্টের মত)। হিষ্টিরিয়াগ্রস্তা স্ত্রীলোকদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। ন্যাজা — হৃদ্রোগের সঙ্গে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট। ঘুমালে দম বন্ধ হয়ে আসে। কেলি-রাই-বর্ষা বা শীতের ঠান্ডাতে হাঁপানির টান বাড়ে, কাশি হয়, ভোর ৩/৪টায় বাড়ে; গয়ার আঠার মত, টানিলে দড়ির মত লম্বা হয়ে যায় অথবা মুখ দিয়ে ঝুলতে থাকে।
মেহরোগ।-মূত্রনলীর সঙ্কোচন, প্রস্রাব বন্ধ, সূতার মত হয়ে নস্য রঙের হড়হড়ে পদার্থ ঝরিতে থাকে এবং কয়েক ফোঁটা রক্তময় পানির মত পদার্থ বের হয়। গ্রীট, চটচটে আঠার মত স্রাব এবং তাতে মূত্রনলীর মুখ বন্ধ থাকে। রোগী বিষণ্ন ও হতাশ। চর্ম শুষ্ক। ঘাম হয় না। শীত করে। শরীরে চর্মরোগ।
শোথ।-উদরের শোথ ও সেইসঙ্গে চর্মরোগ, উদ্ভেদ হতে মধুর মত ঘন চটচটে রস বের হয়। উদরের ফুলা ক্রমাগত বাড়িতেই থাকে। হাত-পায়ের ফুলা খুবই বেশী। হাঁটুর নীচে সমস্ত পায়ের চামড়া ফেটে অনবরত রস ঝরিতে থাকে (লাইকো, রাস-টক্স)। পেট ফোলা। চামড়া হতে ছাল উঠে যায়।
কোষ্ঠবদ্ধ, উদরাময় ও অজীর্ণরোগ।– মিষ্টদ্রব্য খেলে গা-বমি-বমি করে। গরমদ্রব্য (hot) সহ্য হয় না। বুকজ্বালা, খই ঢেঁকুর। দুর্গন্ধ বায়ু নিঃসরণ। কোষ্ঠবদ্ধতা, শক্ত মল কষ্টে বের হয়। মলের সাথে শ্লেষ্মা জড়ান থাকে। উদরাময়, দুর্গন্ধ পিঙ্গলবর্ণ মল। পচা ডিমঘোলানর মত পিচ্ছিল। ঠান্ডা লেগে বা পামা বসে গিয়া শিশুদের উদরাময়। মুখে দুর্গন্ধ। শীত করে। মাছ ও মাংসে অরুচি।
চোখের অসুখ।-চোখপ্রদাহে চোখের পাতা ভারী ও মোটা হয়, অসাড় ও পক্ষাঘাতের মত হয়, চোখ আপনা হতে বুজে যায়, চোখের প্রান্তে খুস্কি বা আইসবৎ পদার্থ, বিশেষতঃ যখন ক্যান্থাস ফেটে রক্ত পড়ে এবং চোখের পাতার ধারগুলি রক্তশূন্য ও ফ্যাকাসে দেখায়, সকালবেলা চোখ জুড়ে যায়। বার বার আঞ্জনি। এই রোগে যদিও পালসেটিলা প্রধান ঔষধ কিন্তু গ্রাফাইটিসের লক্ষণের সাদৃশ্য থাকলে গ্র্যাফাইটিসই ব্যবহার্য্য। চোখের পাতার উপর অর্বুদ বা অনেকবার আঞ্জনি উঠবার পর সেটা শক্ত টিউমারের মত হয়। অক্ষরগুলি যুগল বা গায়ে গায়ে সংলগ্ন দেখায়। চোখের পাতার চুল বেঁকে চোখতারায় লেগে চোখের প্রদাহ উৎপাদন করলেও এটা উপযোগী। চোখের পাতায় চুল, আঁইসব পদার্থসমূহ লেগে থাকে।
কর্ণরোগ।-গ্রাফাইটিস রোগীর কানের ভিতরটা অত্যন্ত শুকনো, সেজন্য রোগী কোন জিনিস চিবাইতে ও গিলতে গেলে কানের ভিতর কড়কড়, ভোঁস ভোঁস করে। রোগীর শ্রবণশক্তি খুব কমে যায়। রোগী গোলমালের ভিতর, গাড়ীতে চড়ার সময় এবং রেলগাড়ীর ভিতর ভাল শুনতে পায়। গ্র্যাফাইটিস রোগী কানের ছিদ্রমুখে একখানা পর্দা দ্বারা ঢাকা আছে এমন অনুভব করে, ঐজন্য কানের ভিতর সাঁই সাঁই শব্দ হয় (কষ্টি, পেট্রোসেল, পালস), কখনও বা কানের ভিতর দুমদাম শব্দ হয় (ম্যাঙ্গে, মস্কাস, সাইলিসিয়া)। দন্তোদ্গমের সময় শিশুদের কানের পিছনে চটা ঘা হয় এবং সেটা হতে রস পড়ে।
চর্মরোগ।– গ্র্যাফাইটিস একজিমা, দাদ, খুস্কী, ঘা ও নানাজাতীয় উদ্ভেদাদির উত্তম ঔষধ। রোগীর চামড়া অত্যন্ত খারাপ। শরীরে সামান্য ক্ষত হলেও তাতে পুঁজ হয়। পুরাতন ক্ষতচিহ্নসকল পুনরায় ক্ষতে পরিণত হয়। এটার চর্মরোগে জ্বালা থাকে এবং ক্ষত হতে মধুর মত আঠা স্রাব নিঃসৃত হয়। এটার চর্মরোগ কানের পশ্চাতে, অঙ্গুলিগুলির উপর, মাথার পিছনে এবং শরীরের নানাস্থানে হয়ে থাকে। তুলনীয়।-পেট্রোলিয়াম -এটাতেও একজিমা জাতীয় চর্মরোগ আছে। ফেটে যায়, জ্বালা ও যন্ত্রণা হয়, চটা পড়ে, তবে এতে রস পড়া নেই, মাঝে মাঝে রক্ত পড়ে। এটার চর্মরোগ ঝড়-ঝাপ্টা ও আর্দ্রতায় এবং শীতকালেই বেশী হয়। নাক্স-জুগ্লান্স- মাথার একজিমা, সেটা অত্যন্ত লাল হয় এবং চুলকায়। কানের পশ্চাতে একজিমা, হাতে ও বগলে পাঁচড়া হলেও এটা কাজ করে। হিপার-সাক্ষ-এটার চর্মরোগ অতি সহজে থাকে ও পুঁজ হয়। রোগীর মানসিক অস্থিরতা অত্যধিক, টাটান ব্যথাও তীব্র। হিপারে ঘাম অত্যধিক এবং সেটা টক গন্ধবিশিষ্ট। ভিঙ্কা-মাইনর-মাথায়, মুখে ও কানের পশ্চাতে অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত উদ্ভেদ বের হয় এবং সেটাতে পোকা পড়ে। আস্তে আস্তে ঐ উদ্ভেদ ঘায়ে পরিণত হয় এবং সেটার উপর মামড়ি পড়ে এবং মামড়ির নীচে পুঁজ জমে। চুল উঠে যায়। আর্সেনিক -এটার একজিমায় জ্বালা থাকে, কিন্তু সেটা প্রায়ই শুষ্ক। ডাঃ হিউজেস বলেন-আর্সেনিকের মত গ্রাফাইটিসেরও চর্মের উপর পরিপোষক ক্রিয়ার অভাব আছে। শিশুর মাথায় একপ্রকার ঘা হয়, তাতে ভয়ানক দুর্গন্ধ আছে। আর্সেনিকের পর গ্র্যাফাইটিস, আবার গ্র্যাফাইটিসের পর আর্সেনিক ব্যবহৃত হয়। আর্সেনিক উত্তাপে ভাল থাকে। ভায়োলো-ওডোরেটা-এটার একজিমার লক্ষণ অনেকটা ভিনকার সমতুল্য। এই ঔষধের প্রধান প্রধান লক্ষণ-শিশুর প্রস্রাবে গন্ধ, ঠিক বিড়ালের প্রস্রাবের মত। সোরিণাম-দুর্গন্ধই এটার প্রধান লক্ষণ। এটার চর্মরোগ শয্যার উত্তাপে ও স্নানে বৃদ্ধি, কিন্তু মোটা হওয়ার প্রবণতা সোরিণামে নেই। আর্কটিয়াম-ল্যাপ্পা—এটার চর্মরোগ হতে ভিজে-ভিজে গন্ধ বের হয় এবং উদ্ভেদগুলির উপর সাদা ছাই রঙের মামড়ি পড়ে, গ্ল্যান্ডগুলি ফুলে উঠে, বিশেষভাবে বগলের গ্রন্থিগুলি। কখন কখনও গ্ল্যান্ডগুলি পাকে। সালফার – এটার চর্মরোগের চুলকানি ভয়ানক, রোগী যতই চুলকায় ততই তার চুলকানির বৃদ্ধি হয়, এমন কি আঁচড়াতে আঁচড়াতে রক্ত বের করে। মার্কারি-এটার চর্মরোগের চুলকানি রাত্রে বিছানার উত্তাপে বৃদ্ধি পায়, সেইসঙ্গে মার্কারির রস’ল জিহবা অথচ পিপাসা বিদ্যমান থাকে।
যকৃতের রোগ ও উদরশূল। – পাকযন্ত্রের নানাবিধ রোগে রোগীর মুখ হতে বিশেষতঃ সকালে অত্যন্ত দুর্গন্ধ বের হয়, এমন-কি ঐ দুর্গন্ধ এক এক সময় এত তীব্র হয় যে, রোগীর মুখের কাছে মুখ আনা যায় না। মুখ হতে ডিমের গন্ধ বের হয়, সে নিজেও ঐ গন্ধ পায়। গ্রাফাইটিস-রোগী মাংস খেলে পাকাশয়ের গোলমাল বেশী হয়। গ্রাফাইটিস রোগীর প্রায়ই উদরশূল পাওয়া যায়। রোগীর যকৃৎ যে কেবল ব্যথাযুক্ত হয় তা নয়, শক্তও হয়ে উঠে। কিন্তু খাওয়ার পর পেটটি বায়ুতে ফুলে উঠে, সেই সময় অত্যস্ত দুর্গন্ধ বায়ু নিঃসরণ হয়ে থাকে। মুখ ম্লান ও হলদে হয়ে যায়, মৃৎপান্ডু রোগ। উদরশূলে রোগীকে অস্থির করে তুলে তখন কিছু খেলে ঐ ভাবটা কমে যায়। তুলনীয়।-পেট্রোলিয়াম -এটার শূলব্যথাও আহার করার পর কমে যায়। যতবার শূলের বেদনা উপস্থিত হয়, ততবার কিছু খেতে বাধ্য হয়। কিন্তু এটার রোগী গ্রাফাইটিসের মত মোটাসোটা নয় বা মলকাঠিন্য এতে নেই, বরং উদরাময়ই বেশী। অ্যানাকার্ডিয়াম- শূন্যপেট হলেই শূলবেদনার বৃদ্ধি এবং আহারের পর উপশম। এটার রোগীর মানসিক লক্ষণটি বিচার্য্য, রোগী মনে করে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। চেলিডোনিয়াম ও লাইকোপোডিয়াম – এদের শূলবেদনাও কিছু খাওয়ার পর উপশম হয় এবং যা কিছু খেয়ে থাকে গরম গরম খায়। চেলিডোনিয়াম ও লাইকোপোডিয়াম উভয় রোগীরই যন্ত্রণা বৈকাল ৪টা হতে ৮টায় বৃদ্ধি, উভয় রোগীর উদরাময় ও কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তবে লাইকোর রোগীর ছাগলের নাদির মত বড়ি-বড়ি মলত্যাগ করে, (প্লাম্বাম)। গ্র্যাফাইটিসের রোগী কেবল গরম দুধ পান করতে চায়, তাতে শূলের উপশম হয়। চেলিডোনিয়াম রোগীর ডান দিকের পিঠের হাড়ের নীচে সব সময় ব্যথা থাকে।
অর্শ ও ভগন্দর।-রোগীর অর্শের রোগ থাকে, ঐ সকলের ভিতর এত জ্বালা, যন্ত্রণা, টাটানি, সূঁচফোটান ব্যথা থাকে যে, রোগী বসতে পারে না, বসতে গেলে কষ্ট হয়, ফেটে যায়। রোগীর গুহ্যদ্বারটি অর্শবলতে পূর্ণ থাকার জন্য শক্ত মল নিঃসরণের সময় মলদ্বার ফেটে চটচটে মধুর মত বর্ণহীন রস বের হয়। তুলনীয়।-অ্যাসিড-নাইট্রিক-ভগন্দর রোগীর গুহ্যদ্বারের ভিতরে ছোট ছোট কাঠি দ্বারা কেউ খুঁটিতেছে এমন অনুভব। মলত্যাগের পর অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত মলদ্বারে যন্ত্রণা। প্রস্রাবে অতি দুৰ্গন্ধ। সাইলিসিয়া -মলত্যাগের বেগ দিবার পরে কিছুতেই মলত্যাগ হয় না, যদিও বা বের হওয়ার উপক্রম হয়, পুনরায় তা উপরের দিকে উঠে যায়। র্যাটানহিয়া-ভগন্দর রোগীর মলদ্বার অত্যন্ত ফাটা-ফাটা। মলত্যাগের পর বহুক্ষণ স্থায়ী জ্বালা ও বেদনা থাকে। পিওনিয়া – ভগন্দর হয়ে রোগীর মলদ্বার হতে সব সময় রস বের হয়ে মলদ্বার ভিজা-ভিজা থাকে, মলদ্বারে টাটানি ও চিড়িকমারা ব্যথা।
গন্ডমালা রোগ বা স্ক্রোফিউলা। -শিশুদের স্ক্রোফিউলা রোগে শিশুর পেটটি বড় ও শক্ত; বগল, ঘাড়, কুঁচকি ও মেসেনট্রিক গ্রন্থিসকল ফুলে উঠে। উদরাময় ও সেই সাথে চর্মরোগ, বিশেষতঃ কানের পিছনে চটা ঘা থাকে এবং ঐ ঘা হতে মধুর মত রস ঝরিতে থাকে। তুলনীয়।– অ্যালনাস-গ্ল্যান্ড যখন খুব বড় হয় এবং বেল, অ্যামিল, হিপার-সাক্ষ প্রভৃতি ঔষধে বিশেষ ফল পাওয়া যায় না তখন এই ঔষধটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অপারকিউলিনা- লসিকা গ্রন্থি (lymphatic gland) অভ্যস্ত বড় এবং শক্ত হয়, ফোঁড়া হলেও তা শীঘ্র পাকে না। ব্রোমিয়াম – গন্ডমালা দোষ; নিম্ন চোয়ালের গ্রন্থি বড় ও শক্ত। আয়োডাম প্রয়োগের পরে এটা ব্যবহারে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। সিষ্টাস-ঘাড় ও গলার ভিতরের গ্ল্যান্ড ফোলে ও বড় হয়। দড়িতে পর পর গাঁট দিলে যেরূপ অবস্থা হয়, গন্ডমালা, সেইরূপ দেখায়। কোনায়াম-গ্ল্যান্ড যখন পাথরের মত শক্ত হয়, তখনই এটা ফলপ্রদ হয়ে থাকে। ট্রাইফোলিয়াম – নিম্ন চোয়ালের এবং কর্ণমূলের গ্ল্যান্ড ফোলে, বড় ও শক্ত হয়। ব্যাডিয়াগা -সমস্ত গ্ল্যান্ডই পাথরের মত শক্ত।
মেদরোগ। -যে সকল স্ত্রীলোকের পেট ও কোমর প্রসবের পর অত্যধিক মোটা হয়ে যায়, এমন-কি পেটটি মোটা থলথলে হয়ে ঝুলে পড়ে, তাদের পক্ষে এই ঔষধ বিশেষ উপযোগী। মেদরোগের সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং চর্মরোগ। ফিউকাস-ভেসি-কিউলোসিস- এই ঔষধ মেদরোগ ও শরীরের স্থূলতা কমাইতে অদ্বিতীয়। শরীরের চর্বি কমাইতে ফাইটোলাক্কাও বিশেষ উপযোগী। এটা সেবনে চর্বির বৃদ্ধি স্থগিত হয়। থাইরইডিনামও এই অবস্থায় একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। ক্যাঙ্কে কার্বের রোগী শীঘ্র শীঘ্র মোটা হয়ে পড়ে।
কু-নখ, কেশ-পতন, স্তনরোগ। -মোটাসোটা গন্ডমালা ধাতু ব্যক্তির নখের স্থূলত্ব কাঠিন্য ও বিদারণ জন্মিলে গ্র্যাফাইটিস তার একমাত্র ঔষধ। রোগীর চুল উঠে গেলেও এই ঔষধ ব্যবহাৰ্য্য। ডাঃ গারেন্সি বলেন-ল উঠে যাওয়া এবং নখের অস্বাভাবিক বিবর্দ্ধন এই ঔষধ দ্বারা আরোগ্য লাভ করে। স্ত্রীলোকদের স্তনের অর্বুদ রোগ, স্তনে প্রদাহ ও ব্রণ হয়ে স্তনের মধ্যে কাঠিন্য। স্তন্যদায়িনীদের স্তনের বোঁটা ফেটে ঘা। স্তনের বোঁটা ফেটে ঘায়ে পরিণত হলে গ্রাফাইটিসের মলম বাহ্যপ্রয়োগ করা কর্ত্তব্য। স্তনের ফোঁড়ার পর শক্ত উঁচু ক্ষতচিহ্ন থাকে এবং সেটা পাকিলে ক্যান্সারে পরিণত হয়। স্তনদুধের লোপ, ঠুনকো বা ফোড়ার পরবর্ত্তী একনি।
স্ত্রীরোগ। রোগিণী মোটা, থলথলে ও গৌরবর্ণা (fat fair and flabby), কিন্তু রক্তশূন্য, হরিৎপান্ডু রোগগ্রস্তা। সামান্য একটু ঠান্ডা লাগলেই সর্দি-কাশি হয়, সেইসঙ্গে অত্যধিক কোষ্ঠবদ্ধতা। চর্মরোগ থাকলে অথবা স্তন ফাটা ফাটা থাকলে নির্ভাবনায় এ্যাফাইটিস প্রয়োগ করা চলে। গ্রাফাইটিস রোগীর সঙ্গমে অনিচ্ছা থাকে, ঠান্ডা লাগলেই ডিম্বকোষ ফোলে ও শক্ত হয়। ঋতুর আগে ও পরে ডিম্বকোষের নিষ্পেষণ ও স্ফোটনবৎ বেদনা। গ্র্যাফাইটিস রোগিণীর ঋতু বিলম্বে প্রকাশিত হয়, স্রাব অত্যল্প, ঋতুর সময় অসহ্য যন্ত্রণা হয়, কিন্তু দিনে রাত্রে যথেষ্ট প্রদরস্রাব হয়। তুলনীয়।-ক্যাল্কেরিয়া-কার্ব-পেট মোটা এবং মেদযুক্ত। গ্রাফাইটিসের মত ঠান্ডা সহ্য হয় না। রক্তশূন্য অবস্থা -রক্তে শ্বেত-কণিকার ভাগ বেশী, চর্মরোগে মাথার উপর একজিমা -পুরু মামড়ি পড়ে, কিন্তু গ্রাফাইটিসের চর্মরোগ অন্য প্রকারের ফাটা-ফাটা, সেটা হতে পাতলা মধুর মত কষাণি ঝরে। ঋতুর আগে ও সময়ে রোগিণীর কাশি হয়, বাম স্তনের নিম্নে তীব্র বেদনা হয়ে থাকে। পালসেটিলার ঋতুস্রাবও ফিকা ও সামান্য এবং বিলম্বে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু পালসেটিলা রোগিণীও মাঝে মাঝ শীত-শীত ভাব অনুভব করে এবং জিহবা শুষ্ক, অথচ পানিপিপাসা থাকে না। রোগিণী সর্বদাই বিষণ্ন এবং অশুভ কামনা করতে থাকে, গায়ে হাত দিলে তার শরীরে যে উত্তাপ আছে তা মনেই হয় না। রক্তাল্পতার জন্য হৃৎপিন্ডে কম্পন দেখা দেয়। জরায়ুর স্থানচ্যুতিতেও এটা ব্যবহৃত হতে পারে-যখন দেখিবে জরায়ু স্থানচ্যুত হয়ে “অস” পশ্চাৎদিকে সরেগেছে তখন এটা ব্যবহার্য্য। জরায়ুর স্থানচ্যুতির সাথে সামনের দিকের বক্রতায়ও এটা উপযোগী। ক্যান্সাররোগে জরায়ুর মুখ শক্ত ও ফোলা, সেই স্থানে বড় বড় শক্ত উদ্ভেদ, স্রাব কাল ও দুর্গন্ধ। স্ত্রীযন্ত্রে আগুনের মত জ্বালা, পেট হতে উরু পর্য্যন্ত বেদনা।
সবিরাম জ্বর।-জ্বর দুইদিন অন্তর কখনও বা তিনদিন অন্তর হতে পারে। জ্বরাবস্থা -রাত্রে উত্তাপের সাথে রোগী ভয়ানক ছটফট করে, ছটফটানির জন্য ঘুমাতে পারে না। হাত-পা খুব গরম ও জ্বালাযুক্ত। সন্ধ্যার সময় তার শরীর গরম হতে আরম্ভ করে, সমস্ত রাত্রি ঐ গরম ভোগ করে, সেইসঙ্গে মাথার ব্যথা ও ঘাড়ের ব্যথা বিদ্যমান থাকে। ঘর্মাবস্থা-এটার ঘাম টকগন্ধযুক্ত, প্রচুর এবং সামান্যমাত্র নড়াচড়ায় ঘামের বৃদ্ধি। রোগীর কাপড়ে ও বিছানায় ঘামের হলদে বর্ণের দাগ পড়ে। গ্র্যাফাইটিসের রোগীর মুখ হতে তীব্র গন্ধ এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হতে প্রস্রাবের গন্ধ বের হয়। জ্বর ছাড়িবার পর কখনও খুব ক্ষুধা থাকে। কোষ্ঠবদ্ধতা প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
মুখমন্ডল। -গ্র্যাফাইটিসের রোগী মুখমন্ডলে মাকড়সার জাল লেগে আছে এমন অনুভব করে। মুখমন্ডল গোসল ও হলদে হয়ে যায়। মুখ এবং পায়ের পক্ষাঘাতেও এটা ব্যবহৃত হয়। পক্ষাঘাতের ফলে রোগীর মুখমন্ডলের পেশী বেঁকে যায়-তাঁর কথা জড়িয়ে যায় ও স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারে না। রোগীর ঠোট দুইটি ফাটা-ফাটা, মুখের দুই কোণও ফাটা এবং সেখানে ক্ষত উৎপন্ন হয়ে থাকে।
পুংজননেন্দ্রিয়ের রোগ। -এই ঔষধে পুরুষের সঙ্গমে ইচ্ছা থাকে না। জননেন্দ্রিয়ের উপর রসপূর্ণ ফুস্কুড়ি বের হয় এবং সেটা হতে রস ঝরিতে থাকে। সঙ্গমের সময় জঙ্ঘাডিমের পেশীতে খিল ধরে, পা দুইখানি শীতল ও অবসন্ন হয়, কিন্তু শরীর গরম হয়ে ঘাম বের হতে থাকে। পুরুষত্বহীনতা এবং প্রজননশক্তির অভাব ঘটে।
প্রস্রাব।-রোগীর প্রস্রাব যন্ত্রণাদায়ক, মূত্ৰনলী মধ্যে সূঁচফোটান বেদনা অনুভব করে। ফোঁটা- ফোঁটা, পরিমাণে অল্প, গাঢ় লাল প্রস্রাব হয়, সেটা অত্যল্পকাল পরেই ঘোলা হয়ে যায় এবং ঈষৎ তলানি পড়ে।
নিদ্রা-দিনের বেলা ও সন্ধ্যার পরেই খুব ঘুম পায়, কিন্তু ভাল নিদ্ৰা হয় না; রোগী ঘুমের ভিতর মৃত্যু ও আগুনের স্বপ্ন দেখে। ঘুমের ঘোরে অনবরত কথা কহে ও কখন কখনও বিছানায় প্রস্রাব করে (সিনা, সিপিয়া)।
সম্বন্ধ।-আর্সেনিক ও ফেরাম-মেট গ্র্যাফাইটিসের অনুপূরক; গ্রাফাইটিস ফেরাম-মেটের পর উপযোগী এবং মৃৎপাত্তুরোগে সেটার সমগুণ। ডাঃ অ্যালেন বলেন, স্ত্রীলোকদের ঋতু-আরম্ভ- পালসেটিলা যেরূপ উপযোগী, সেইরূপ ঋতু-নিবৃত্তিকালে গ্রাফাইটিস কাজ করে। পালসের সমস্ত লক্ষণ দুধ পানে বৃদ্ধি এবং গ্রাফাইটিসের দুধ পানে সমস্ত লক্ষণের উপশম।
বৃদ্ধি। সকালে; সন্ধ্যাকালে; উপরে চাইলে (মাথাঘোরা); হেঁট হলে (মাথাঘোরা); চোখ খুললে (হাঁচি); ঋতুকালে, রাত্রে ক্ষুধা পেলে; বামদিকে; মধ্যরাত্রে (শ্বাসকষ্ট); মিষ্টদ্রব্যে; ঠান্ডা পানীয়ে; ঠান্ডা বায়ুতে; বর্ষার হাওয়ায়; পানিতে ধুইলে; স্নানে; হামের পর (মুখের পক্ষাঘাত); ভিজিলে (ঋতু)।
হ্রাস।– খেলে (শ্বাসকষ্ট); অন্ধকারে; গায়ে কাপড় জড়ালে; ঢেঁকুর উঠলে; বিশ্রামে; গাড়ী চড়লে (বধিরতা); গরম দুধ পান করলে।
শক্তি।-৬x বিচূর্ণ, ৬, ২০০, ১০০০ বা তদূর্দ্ধ ক্রম। মলদ্বার ও স্তনের ক্ষতরোগে ৩x বিচূর্ণের মলম ব্যবহার্য্য।